ভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা এবং অভূতপূর্ব করোনা

Farid Ahmad
44 min readMay 3, 2020

ফরিদ আহমদ

দাদুভাই ইন্ডিয়ান আর্মিতে ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে সেনা সৈনিকের সুঠামো শরীর ওলাবিবির রক্তচক্ষুর কবলে পড়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। হাফকিনের কলেরার টিকা বিশ্বজুড়ে প্রসার লাভ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। লাখো সৈনিকের প্রাণ বাঁচিয়েছিলো টিকাটি। প্রথম ভ্যাকসিন নিতে কেউ রাজি না হওয়ায়, প্লেগের টিকার মতো নিজের আবিস্কৃত এই টিকাটি সাহসী হাফকিন নিজের ওপরই প্রয়োগ করেছিলেন। টিকার ধাক্কায় প্রথমে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লেও পরোপকারী মানুষটি কোনরকমে প্রাণে বেঁচে যান। নানা দেশ ঘুরে ১৮৯৩ সালে তিনি কলকাতায় এসেছিলেন এখানকার কলেরা নির্মূলে কাজ করতে। ১৮০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় ৪ কোটি মানুষ।

সৈনিক দাদুর মৃত্যুতে তাঁর অবুঝ সন্তান সংকল্প করেছিলেন বড় হয়ে সে প্রতিরক্ষা বাহিনীতে যোগ দিবেন। নবীন যুবক ১৯৪৯ সালে সেনাবাহিনীর কমিশন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন । লিখিত পরীক্ষায় ‘Battlefield’ এর উপর রচনা লিখতে বলা হয়। লিখেছিলেন, ‘A human hand drops its pencil when it finishes the awful picture of a battlefield.’। লিখিত সহ সকল পরীক্ষায় প্রথম হয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য করাচী থেকে আসা এক চিকিৎসকের সম্মুখে তরুণ যথারীতি উপস্থিত হলেন। ছেলেবেলায় জমিতে ধান কাটতে গিয়ে বাম হাতের কনিষ্ট আঙ্গুলটি কেটে যায়। তা ঠিকমত সেরে উঠেনি। অঙ্গুলের ডগাটি কিঞ্চিত বাঁকা হয়ে জোড়া লেগেছিল। চিকিৎসক এ বিষয়ে অভিভাবককে যোগাযোগ করতে বললেন। এ ত্রুটির জন্য রাইফেল চালাতে কোন অসুবিধা হবেনা বলে নিয়োগ কমিটির আলোচনায় সেনাসদস্যরা মত প্রকাশ করেছিলেন।

অভিভাবক হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন স্বপ্নকাতর যুবকের আপন বড় মামা জেলার অতিরিক্ত উপ কমিশনার। চিকিৎসক বললেন, ‘আমি আরেকটি নির্বাচনী পরীক্ষায় যাবো। সময় থাকলে আপনিও আমার সাথে ট্রেনে চড়তে পারেন। ভাগিনার স্বপ্ন পূরণে মামা ট্রেনে চড়েছিলেন। রেলগাড়ীর ঝমাঝম শব্দের মাঝে একথা সেকথা বলে করাচীর চিকিৎসক মহোদয় কমিশনার সাহেবের কাছে একশো টাকা চাইলেন। কমিশনার তাতে রাজী হননি। এভাবেই দাদুর মতো সেনাবাহিনীর একজন গর্বিত সৈনিক হওয়ার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছিল আমার বাবার। হয় কমিশনার দাদু না হয় পশ্চিমা চিকিৎসক নয় কনিষ্ট আঙ্গুলের জন্য দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ হয়নি এক যুবকের। এক একজন মানুষ এক একভাবে কারন বিশ্লেষণ করবে। আর এটাই স্বাভাবিক। মনে হচ্ছে দাদু অতি মাত্রায় সৎ বা কৃপণ ছিলেন। তাই হারাম ঘুষ দিয়ে হালাল আয়ের ব্যবস্থা করেননি বা নিজের পকেট থেকে সেসময়ের একশো টাকা খরচ করার সাহস ছিলোনা। ডাক্তার সাহেবও সৎ ছিলেন কারন তিনি ত্রুটিপূর্ণ আঙ্গুল নিয়ে কাউকে সেনাবাহিনীতে নিয়োগের সুপারিশ করে অন্যায় করেননি। হয়তো একশ টাকা চাওয়াটা তার একটা বাহানা ছিলো মাত্র। এসব কথা হচ্ছিল আমার বাবার সাথে বিটিভিতে কোন একটা নাটক দেখতে গিয়ে। নাটকটিতে একজন জমিদারকে সংবাদ দিচ্ছিল এই বলে, ‘হুজুর, খবর পাইলাম ঐ গ্রামে ওলা উঠছে।’

বাবার এক চাচা ছিলেন। তিনি একটু ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। অনেকে উনাকে সাধু-সন্ন্যাসী মনে করতেন। কোন বাড়িতে ওলা উঠলে সুস্থরা সেখানে ভয়ে যেতেন না। তিনি দৌঁড়ে সে বাড়িতে গিয়ে আগে আযান দিতেন। তারপর রোগীদের সেবা শুশ্রুষায় লেগে যেতেন। গরম ভাতকে নরম করে লবন পানি মিশিয়ে তিনি তাদেরকে খাওয়াতেন। মৃতদের গোসল দিতেন। দাফনের-কাপনের ব্যবস্থা করতেন। তাদের জন্য কবর খুঁড়তেন। আনন্দের বিষয় এই যে, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র রাইস স্যালাইন উদ্ভাবন করে কলেরা নির্মূলে পৃথিবীকে আলোর পথ দেখায়। এভাবেই প্রথম বাবার কাছ থেকে মহামারীর বিষয়ে জেনেছিলাম।

১৯৮৪ সালে আমার কঠিন জ্বর হলো। কিছুতেই সারছিলনা। অবশেষে ডাক্তার বললেন, আমার ম্যালেরিয়া হয়েছে। চিন্তার কোন কারন নেই। ভালো ওষুধ আছে। ইংল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে আসে। ওষুধটির বানিজ্যিক নাম এভলোক্লোর। এখানকার ফার্মেসিতে পাওয়া যায়। বাবা ওষুধ নিয়ে আসলেন। খেয়ে আল্লাহর রহমতে সুস্থ হলাম। অবশ্য আমার রঙীন ঠোঁট পুড়ে কালো হয়ে গিয়েছিল। সেজন্য আজ অবধি যত্রতত্র একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হই। অপনি কি প্রচুর ধূমপান করেন? এখন শুনছি খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগ থেকেই ম্যালেরিয়া গোটা বিশ্বকে কাবু করার যাত্রা শুরু করেছিল। আর মৃত্যু হয়েছে কোটি মানুষের। কলম্বাস আমেরিকা গিয়ে দেখতে পেলেন, সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীরা এক প্রকার গাছের বাকল ব্যবহার করে সেরে উঠছে এই রোগ থেকে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুর সেই গাছকে পরবর্তীতে নাম দেওয়া হয় সিনকোনা। সে গাছ থেকেই বানানো হয় ‘কুইনাইন’। আর এভলোক্লোরে ছিল সেই কুইনাইন। যা খেলে ম্যালেরিয়া সেরে উঠে।

অণুবীক্ষণ যন্ত্র বিহীন পৃথিবী অনেক মহামারী দেখেছে। ব্রিটিশ মেডিকেল অফিসার ডাক্তার ডোনাল্ড রস আঠারো শতকের শেষ দিকে ভারতবর্ষে চাকরিরত ছিলেন। তিনি মশার শরীরে পাওয়া এই জীবাণু কীভাবে মানুষের শরীরে আসে তা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। এরই মধ্যে তাকে মাদ্রাজ থেকে ম্যালেরিয়ার প্রকোপমুক্ত অঞ্চলে বদলি করার কথা উঠলে তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দেন। তাঁর জেদের কাছে হেরে গিয়ে তাকে সেখানেই রেখে দেওয়া হয়। ম্যালেরিয়ার গবেষণার জন্য বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি পরীক্ষা চালিয়ে প্রমাণ করতে সক্ষম হন, মশার কামড়েই মানুষের শরীরে ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্রবেশ করে। তখন ব্রিটিশ সরকার ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়া অন্যান্য অঞ্চলে মশা নির্মূলে কাজ শুরু করে। ধীরে ধীরে ম্যালেরিয়ার প্রকোপও কমে আসতে থাকে। প্রতিষেধকের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। ডোনাল্ড রসের এই চিন্তা ম্যালেরিয়া নামক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের প্রধান হাতিয়ার হয়ে ওঠে। তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।

আমাদের এক প্রতিবেশী ছিলেন গোলাম মোস্তফা ভাই। তার মুখখানির দিকে তাকাতে তখন ভীষন ভয় পেতাম। রসায়নবিদ শ্রদ্ধেয় বড় ভাই বললেন, ‘ভয়ের কিছু নেই।’ গুটিবসন্ত রোগের কারনে উনার এরকম হয়েছে। ভাগ্যিস মোস্তফা ভাই বেঁচে আছেন। ষোড়শ শতাব্দীর শুরু থেকে এ রোগের প্রাদুর্ভাব শুরু। একথা সত্যি কিনা জানিনা, বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত গুটিবসন্তে প্রায় ৫০ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৭৯ সালে গুটিবসন্ত নির্মূলের ঘোষণা দেন।

১৯৮৫ সালের অক্টোবর মাস। সুযোগ পেয়ে ছোট চাচার সাথে বসে বিটিভিতে মুভি দেখছিলাম। চাচার প্রিয় নায়কের ছবি। ভালোই লাগছিল। ছবিতে দুটো কিউট পাপ্পি ছিলো। ছবির শেষে অবশ্য বুঝতে পারলাম ঐ গুলো যন্ত্রের কুকুর ছিলো। কোন সায়েন্স ফিকশন ছবি হবে হয়তো। চাচা ঢাকা থেকে অফিসের কাজে হোম টাউনে এসেছিলেন। ছবি শেষে মন খারাপ করে আমাকে জিঞ্জেস করলেন, ‘ভাতিজা এক্টরের নাম কি জানো?’ চাচাকে বললাম, ‘টারজান ছাড়া ইংরেজী কিছু দেখিনা।’ তিনি বললেন, গত সপ্তাহে এইডস রোগে মারা গেছেন। আমি বললাম, ‘চাচা এটা কি রোগ?’ তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘তুই বুঝবিনা।’ মনে খুব দুঃখ হলো। আমার এতো রোগ হচ্ছে ছোটবেলা থেকে আর চাচা বলছেন, আমি বুঝবোনা। যখন প্রাইভেট ম্যাটারগুলো বুঝার বয়স হলো তখন সবকিছু বুঝতে পারলাম।

শখের বশে ডাচ-বাংলা ব্যাংকে চাকুরী করতে গেলাম। কারন ডাচ-বাংলা ফাউন্ডেশন পরিচালিত অনেক সামাজিক কর্মকান্ড আমাকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করেছিল। যোগদান করার অব্যবহিত পরে ব্যাংকের চিকিৎসক আমাকে পাঠিয়ে দিলেন অনেকগুলো রক্তের টেস্ট করানোর জন্য। আরও বললেন, এইডস টেস্টটি যেন ধানমন্ডির ইবনেসিনা ডায়াগনস্টিকে করি। টেস্ট করাতে গিয়ে ব্লাড কালেক্টরের কিছু প্রশ্নে বেশ বিব্রত বোধ করেছিলাম তখন। আসলে একটা রোগ নানা ভাবে ছড়াতে পারে। হয়তো সেটা তার জানা ছিল না। পশ্চিম আফ্রিকায় এই ভাইরাসের উদ্ভব ঘটে। ১৯৮১ সালে এইডস প্রথমবারের মতো শনাক্ত করা সম্ভব হয়। এ পর্যন্ত প্রায় ৮ কোটি মানুষ এইডসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং সাড়ে ৩ কোটির বেশি মানুষ মারা গেছেন এ রোগে।

১৯৯৪ সালে ভারতে প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে ব্যাঙ্গালোরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যাওয়া আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধু প্লেগের হাত থেকে বাঁচার জন্য দেশে ফিরে আসে। এইম ইন লাইফ পরিবর্তন করে বন্ধুবর আইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করে। বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক মহামারির দৃষ্টান্ত হিসেবে প্লেগকে উল্লেখ করা হয়। ভারতে এই মহামারিই সবচেয়ে প্রাণঘাতী রূপ নিয়েছিল। ইতিহাসবিদদের মতে, এই মহামারিকে উপলক্ষ করে ভারতে ব্রিটিশ শাসকেরা ভারতীয়দের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালায় এবং সেসবের মাধ্যমে বিদ্রোহ দমন করে।

পৃথিবীতে এই প্লেগ কয়েকবার এসেছে মহামারি আকারে। মিশরে প্রথম এই রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে এটি ফিলিস্তিন ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। সম্রাট জাস্টিনিয়ান ওই সময় রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাইজেন্টাইনকে একীভূত করার পরিকল্পনা করছিলেন। মহামারিতে সব ভেস্তে যায়। সম্রাট নিজেই প্লেগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তবে ব্যাপক চিকিৎসা নিয়ে তিনি বেঁচে যান। শুরু হয় অর্থনৈতিক সংকট। এই মহামারিতে আড়াই থেকে পাঁচ কোটি লোক প্রাণ হারায়। প্লেগের দ্বিতীয় মহামারি হয় ১৩৪৭ সালে। এটা ছিল কুখ্যাত বিউবনিক প্লেগের মহামারি। ইতিহাসে এটি ‘ব্ল্যাক ডেথ’ হিসাবে পরিচিত। এতে প্রায় বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক–তৃতীয়াংশ লোকের প্রাণহানি ঘটে। আক্রান্ত এলাকায় প্রাণহানির ঘটনা এতোই বেড়ে যায় যে রাস্তাঘাটে পড়ে ছিল শত শত মানুষের লাশ। এই মহামারির কারণে ওই সময়ে চলমান ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যকার যুদ্ধ থেমে যায়। এযাবৎ প্লেগে আক্রান্ত হয়ে ২০ কোটিরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। প্লেগের বিরুদ্ধে মানুষের হাজার বছরের যুদ্ধজয়ের গল্পটি লিখেন কলেরার টিকার অবিস্কারক সেই ওয়াল্ডিমার হাফকিনই।

আমাদের দেশের বাড়ীর সবকটা ফ্ল্যাটের বাচ্চারা হঠাৎ করেই একদিন জলবসন্তে আক্রান্ত হলো। খবর পেয়ে ঢাকা থেকে বাড়িতে গেলাম। প্রকোপ কমে আসলে নিমপাতা, হলুদ একসঙ্গে করে শরীরে মাখিয়ে বাচ্চাদের গোসল করিয়ে দেয়া হলো। তাদের মায়েরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে পরিচর্যা করে শিশুদের সুস্থ করে তুললেন। পোশাক, কাঁথাসহ শিশুদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র ধুয়ে পরিস্কার করা হলো। উইকেন্ডে বাড়ীতে গেলে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা পরিচিতজনের অনেকেই দেখা করতে আসতো। তিন সপ্তাহ ধরে বাড়িতে কেউ আসেনি। এ সামান্য ভাইরাসের রোগের বিষয়ে প্রতিটি পরিবারের সচেতনতা সত্যিই আমাকে মুগ্ধ করেছিল।

বর্তমানে ভাইরাস-সি কে সঙ্গী করে রক্ত ছুটে চলছে নিত্য আমার ধমনী শিরা উপশিরায়। এটা নাকি দীর্ঘ সময় ধরে শরীরে নিরবে নিভৃতে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ১৯৮৯ সালে প্রথম মানবদেহে এর অস্বিস্ত সনাক্ত হয়। ভাইরোলজিস্ট মজা করে আমাকে বললেন, ‘আপনার ভাগ্য ভালো। ওষুধ আবিস্কারের পর আপনার রক্তে এটা পাওয়া গেছে।’ বিজ্ঞানী মাইকেল সোফিয়ার ২০০৭ সালের আবিস্কৃত ওষুধটি, এফডিএ ২০১৩ সালে শুধুমাত্র আমেরিকায় বাজারজাত করার অনুমোদন দেয়। অত্যন্ত দামী এই ওষুধের প্রত্যেকটি ট্যাবলেটের দাম প্রায় হাজার ডলার। পুরো কোর্স কমপ্লিট করতে প্রায় সত্তর লাখ টাকার প্রয়োজন হয়। তবে স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ায় মেধাস্বত্ত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের দুই একটা কোম্পানীকে ওষুধটি তৈরী করার জন্য সহজ শর্তে লাইসেন্স এবং ইনগ্রেডিয়েন্টস দিয়েছে ২০১৭ সালে।

প্রথম সাইকেল শেষে ব্লাড স্ক্রিন টেস্ট রেজাল্ট নেগেটিভ আসলেও ফলোআপ টেস্টটি পজেটিভ এসেছে। তাতে ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। অন্যান্য অসুবিধার জন্য প্রেগইন্টারফেরন ইনজেকশন নেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা বিধায় আগের ওষুধের সাথে অরেকটি নতুন ওষুধের চারটি ক্যাপসুল প্রতিদিন খেতে হচ্ছে। শ্রদ্ধেয় চিকিৎস মহোদয় বলেছেন, ওষুধগুলোর মারাত্নক সাইড এফেক্ট আছে । এটার দখল সামলে নিতে হবে। নিয়মিত যোযোগ করবেন। টাকাপয়সার জোগাড় রাখতে হবে । বোঝা যাচ্ছে ভাইরাস মশায় বেশ বহুরুপী। তাই ওষুধ পাওয়ার সাথে সাথে নিজের টাইপ বদলিয়ে নিচ্ছে।’

দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সারা বিশ্বে হেপাটাইটিস সি ভাইরাসে সংক্রমিত দশজনের মধ্যে নয়জনই জানেন না যে শরীরে এই ভাইরাস তারা বহন করছে। আইইডিসিআর পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার তথ্য মতে হেপাটাইটিসের যে ৫ রকম ভাইরাস আছে তার সবগুলোর সংক্রমণই বাংলাদেশে আছে। হেপাটাইটিস সি ভাইরাস ছড়ায় শুধু রক্তের মাধ্যমে। এটা একটা নীরব ঘাতক। বিশ্বে যত মানুষের লিভার ক্যান্সার হয় তার ৮০ ভাগ ক্ষেত্রেই দায়ী হচ্ছে এই ভাইরাস। পৃথিবীতে গড়ে প্রতিদিন ৪ হাজার মানুষ লিভার রোগে মারা যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ২০১৬ সালের জুলাই মাসেও সি ভাইরাসের উপস্থিতি নেগেটিভ ছিল আমার রক্তে। তখন আমি বারডেম হাসপাতালে হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য ভর্তি ছিলাম। বোধ হয়, বংলাদেশে ওষুধ তৈরীর সুখবর শুনে আমাকে পেয়ে বসেছে। কারন অন্য কোন কারন খুঁজে পাচ্ছিনা।

আমরা এই প্রজন্ম প্রায় প্রতি বছরেই নতুন নতুন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মাধ্যমে অক্রান্ত হয়ে বলি, ‘আজ কয়েকদিন ভাইরাল ফিভারে ভুগছি।’ এক্ষুনে এসে জানতে পারছি, ইনফ্লুয়েঞ্জা বা স্প্যানিশ ফ্লুর উৎপত্তি হয়েছিল চীনে। চীনা শ্রমিকদের মাধ্যমে ১৯১৮ সালের শুরুর দিকে এই ফ্লু কানাডা হয়ে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। স্পেনের মাদ্রিদে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর এর নাম হয় ‘স্প্যানিশ ফ্লু। ১৯১৯ সালের গ্রীষ্মে এই রোগের প্রকোপ কমে আসে। সালফা ড্রাগস ও পেনিসিলিন তখনো আবিষ্কৃত না হওয়ায় স্প্যানিশ ফ্লু অত্যন্ত প্রাণঘাতী রূপে দেখা দিয়েছিল। স্পেনের মোট ৮০ লাখ মানুষ এই ফ্লুতে আক্রান্ত হয়। বিশ্বব্যাপী আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫০ কোটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধারণা অনুযায়ী, ১৯১৮-১৯ সালে বিশ্বের প্রায় ৫ কোটি মানুষ ইনফ্লুয়েঞ্জাতে প্রাণ হারিয়েছেন। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এর পরিমাণ ১০ কোটিরও বেশি হতে পারে। একই ভাইরাসের বিভিন্ন জাত মানুষ, পাখি, শূকর প্রভৃতি জীব প্রজাতির মাধ্যমে এখনো ছড়ায়। তবে ইতিমধ্যে মানুষের মধ্যে ইম্যুনিটি গ্রো করে গেছে।

যুদ্ধক্ষেত্রের ভয়াবহ বিভীষিকাময় চিত্র আঁকতে গেলে শিল্পীর হাত থেকে বারে বারে তাঁর তুলিটি পড়ে যাবে এটিই স্বাভাবিক। ‘A human hand drops its pencil when it finishes the awful picture of a battlefield.’। আমার বাবা সেনাবাহিনীর নিয়োগ পরীক্ষায় ‘Battlefield’ রচনায় এ বাক্যটি লিখেছিলেন। সেটিকে ‘অত্যুক্তি’ হিসেবে অভিহিত করতে পারছিনা। যুদ্ধক্ষেত্রের অতিরঞ্জিত বর্ণনা দিয়েছিলেন বলে মনে হয়না। হয়তো দাদুর কাছ থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অনেক গল্প শুনেছিলেন। তাই সুযোগ পেয়ে শব্দের যাদুতে ভাষার অলঙ্করণে তাহাই ফুটিয়ে তুলেছিলেন। গোটা মানব জাতি আজ পৃথিবী নামক যুদ্ধক্ষেত্রে করোনা নামক অদৃশ্য এক অনুজীব শত্রুর সাথ লড়াই করছে বেঁচে থাকার জন্য। অদ্ভুত এই ক্রিয়েচারটি হাঁচি বা কাশির ড্রপলেটে উপস্থিত থেকে প্রতিটি মানবহাতের স্পর্শে লেগে গিয়ে মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলতে সক্ষম। আমরা সকলেই ভয়াবহ এই স্বৈরাচারীর আধিপত্য থেকে মুক্তি পেতে একটি স্থায়ী সমাধানের সন্ধান করছি।

পুরো বিশ্বকে এখন ভুতুড়ে এক নগরীর মতো মনে হচ্ছে। এখানে যে কোন মুহুর্তে খারাপ কিছু একটা ঘটতে পারে। মানুষ তার পরিবার-পরিজন নিয়ে বাড়ির ভিতরে অবস্থান করছে। ঠিক শজারু যেমনটি লুকিয়ে থাকে তার গর্তের ভিতর। খাদ্য সংগ্রহের প্রয়োজনে শুধুমাত্র গর্ত ছেড়ে বের হয়। কারণ অতি হিংস্র, অদ্ভুতুড়ে এবং ভয়ংকর রকমের অবাধ্য এই শত্রু। যুদ্ধক্ষেত্রে এই শত্রুর মোকাবেলায় আমাদের ব্রহ্মাস্ত্র হচ্ছে মাস্ক, পিপিই, সাবান এবং স্যানিটাইজার। এবং এ দিয়েই অদৃশ্য এই জীবাণুর সাথে দিন রাত লড়ে যাচ্ছি।

সমগ্র মানবজাতি এখন COVID-19 এর বাস্তবতায় হাবুডুবু খাচ্ছে। জীবন-যাপনের মানে প্রত্যেকের কাছে ইতিমধ্যে ভিন্ন রূপ নিয়েছে। আজকাল করোনাভাইরাস নিয়ে গল্প না করে, না শুনে, না পড়ে চব্বিশ ঘন্টা হাবাকালা সেজে থাকা কারো পক্ষে সম্ভব হচ্ছেনা। ডাইনিং টেবিলে COVID-19 নিয়ে আলোচনা বেড়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রলিং এবং ভাইরাল ভাইরাসের চেয়ে বহুগুনে দ্রুত ছড়াচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিশ্ব গুঞ্জনের পরিবর্তে করোনা এখন টক অব দি ওয়ার্ল্ড। সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব মাঝে মাঝেই রাখাল বালকের মতো ‘নেকড়ে বাঘ এলো এলো’ বলে ডাকছে। দুশ্চিন্তা হচ্ছে- করোনা ভাইরাসের ভয় ভাইরাসের চেয়ে বেশি সংক্রামক হতে পারে। আর ভয় মানুষের স্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি করতে পারে। সমগ্র সমাজের সহনশীলতা দুর্বল করে দিয়ে অবিশ্বাস ও বিভ্রান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। সামাজিক অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে। নেতিবাচক চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতি মানুষের মনে অবিরত ঘুরে বেড়াচ্ছে।

ভয়ে লোকজন বুদ্ধিহীনতার পরিচয় দিচ্ছে। যেমন হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলিতে ভিড় জমাচ্ছে। অনৈতিকভাবে খাদ্য সংগ্রহ করছে। এইভাবে দাম বাড়ছে। নিয়মিত সরবরাহ শৃঙ্খলে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। পণ্য সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। নতুন এই করোনা ভাইরাস মানুষকে অচল করে ফেলছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়েছে। অতি সামাজিকদের ছুটিয়ে আড্ডা দিতে দিচ্ছেনা । এবং মানুষকে একঘরে করে রাখছে।

এই প্রজন্ম এর আগে কখনও এমনটা হতে দেখেনি। এমনকি কল্পনাও করতে পারেনি। তারা ইতিমধ্যে এইডস, সোয়াইন ফ্লু, সারস, ইবোলা এবং মারসের মতো মহামারীগুলির সাথে পরিচিত হয়েছে। এগুলোতে যথাক্রমে ৩৫ মিলিয়ন, ২ লক্ষ, ৭৭০, ১১০০০ এবং ৮৫০ জন লোক মারা যায়। তবে সেগুলিকে মানুষ সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। পুরো মানবজাতিকে এরকম কোয়েরেন্টাইন এ থাকতে হয়নি। কারন এগুলোর জীবানু করোনার মতো এতো বেশি সংক্রামক ছিলনা। এতো ছোঁয়াচে ছিলনা। ১৯২০ এর আগে যাদের জন্ম হয়েছিল তাদের বেশির ভাগই এই দুনিয়ায় এখন আর নেই। ১৯১৮-১৯ সালে স্প্যানিশ ফ্লুতে ৫০ মিলিয়ন লোক মারা গিয়েছিল। তাই অনেক দেশ করোনার প্রাদুর্ভাবকে প্রাথমিকভাবে ভূমিকম্পের মতো মোকাবেলা করছিল।

মহামারীর উপস্থিতি বা এর অনুপস্থিতি আমাদের জীবনকে নানাভাবে পাল্টে দেয়। আমাদের চলাফেরার স্বাধীনতার জন্য ওষুধের কাছে অমরা অনেকাংশে ঋণী। উদাহরণস্বরূপ, কন্ট্রাসেপটিভ পিল বা অ্যান্টিবায়োটিক আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখে। মহামারীর সূচনা অতি দ্রুত বাণিজ্য সংকোচন করে। শ্রমিকের মজুরি হ্রাস করে। উত্পাদন ব্যয় বৃদ্ধি করে। অনেকে অনাহারে মারা যায়। একে অপরকে সন্দেহ করে। সামাজিক গতিশীলতা এবং স্বাধীনতা হ্রাস করে। এইভাবে সামাজিক কাঠামোর ভিতকে কাঁপিয়ে দেয়। এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ককে ঝাঁকুনি মারে। তার ভিত নাড়িয়ে দিয়ে যায়।

এই পরিস্থিতিতে গোটা পৃথিবীর একটাই ভাবনা: কখন সবকিছু স্বাভাবিক হবে? কেউই জানেন না কখন করোনার সংক্রমন বন্ধ হবে। আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে সুস্থ ব্যক্তির মধ্যে ছড়িয়ে পড়বেনা। COVID-19 এর আগ্রাসনে সৃষ্ট প্রকৃত ক্ষতির নিরুপন করা অত্যন্ত কঠিন। কারণ এর প্রকোপ এখনও অব্যাহত রয়েছে।

যদি অতি অল্প সময়ের মধ্যে একটি কার্যকরী ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করা সম্ভব হয় তবেই সাধারণ জীবনযাপন অবিলম্বে শুরু হতে পারে। তবে একটি ভ্যাকসিন তৈরি করা এতো সহজ কাজ নয়। এতোটাই কঠিন যে এটাকে হারকিউলিয়ান টাস্ক বলা যেতে পারে। আজকের দুনিয়ায় আমরা অন্যান্য রোগের জন্য যে সব ভ্যাকসিনের উপর নির্ভর করছি তার বেশিরভাগই নিখুঁত ভাবে তৈরী করতে ৫-১৫ বছর সময় লেগেছে। লক্ষ কোটি মানুষের শিরায় ভ্যাকসিন পাম্প করার আগে, এর কার্যকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়ে সুনিশ্চিত হতে, গবেষকরা সাধারনত খুব দীর্ঘ সময় নিয়ে থাকেন। প্রয়োজনে নিজেরাই নিজেদের গবেষণায় গিনিপিগের ভূমিকা পালন করেন।

চুড়ান্ত হতাশার বিষয় হবে যদি কেউ কোন ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে সক্ষম না হয়। তবে সে ক্ষেত্রে করোনার উপস্থিতিতে, অব্যহত সংক্রমনের মাঝে আমাদের জীবন কীভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে? এটি হতে পারে যদি গবেষগণ COVID-19 এ আক্রান্ত রোগীদের সুচিকিত্সার ব্যবস্থা করতে পারেন। আক্রান্তের কষ্ট দ্রুত লাগব করতে পারেন। সর্ম্পূণ নিরাময় নয় বরং এমন কিছু একটা যা রোগীর অকস্মাৎ মৃত্যুকে ঠেকাতে পারবে। প্রলম্বিত করতে পারবে। যদি তা না হয়, তবে মহামারির প্রেক্ষাপটে আমাদের জীবন আবার কীভাবে তার স্বাভাবিক ছন্দ খুজেঁ পাবে।

এজন্য আমাদের পর্যাপ্ত মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে। যাতে করে লোকজন অসুস্থ হলে সেবা নিতে পারে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক, চিকিত্সা সহকারী এবং টেস্ট কিট থাকবে। রোগীর অসুস্থতা নির্ণয় করতে তারা সক্ষম হবে। আইইডিসিআরের মতো আরো জাতীয় পরীক্ষাগার স্থাপন করতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিত্সা সেবা প্রদান করতে সক্ষম হবে এই প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রয়োজনে রোগীদের আইসোলেশন প্রোটোকল অনুসরণ করতে সহায়তা করবে। যুগোপযোগী জরুরি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার মাইলফলক থেকে আমরা এখনও অনেক দূরে আছি।

বর্তমানে পুরো বিশ্বে এক সমুদ্র সমান পরিবর্তন হচ্ছে। প্রতিদিনকার সামাজিকতা, কর্ম পরিচালনা সহ অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে। মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই করার মানসে আমাদের মাঝে যৌক্তিক ও সামাজিক স্থিতিস্থাপকতা তৈরি হচ্ছে। জাত-কুল-ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিটি সম্প্রদায় ভালো সামাজিক অভ্যাসগুলি রপ্ত করার চেষ্ঠা করছে। শিষ্টাচার মেনে চলার চেষ্ঠা করছে। এবং একে অপরের ব্যাপারে আরও যত্নশীল হচ্ছে।

হয়তো এখন থেকে বেশিরভাগ লোকজন বাড়িতে থেকে অফিসের কাজ করবে, ডিজিটাল সম্মেলন করবে, বেশি পরিমাণে অনলাইনে অর্ডার দিবে, অব্যস্ত ও অল্প আসনবিশিষ্ট রেস্তোঁরায় যাবে। সঙ্গীত উত্সব, ক্রাউডেড সমুদ্র সৈকত, নাইটক্লাব বা বারে যেতে সাহস করবেনা। স্পোর্টস লিগগুলি দর্শক ছাড়াই আবার শুরু হবে। বিদেশ ভ্রমণের বিধিনিষেধে বিমানবন্দর কম জনাকীর্ণ হবে। সহপাঠীহীন শিক্ষার্থীরা নিজের ঘরে বসে ক্লাস করবে। ডিস্ট্যান্স লার্নিং এর কৌশলগুলি আরো উন্নত হবে। শিক্ষার্থীদের ক্লাসে বন্ধুদের সাথে মেলামেশা খেলাধুলা করার সুযোগ থাকবেনা।

সম্ভবত লোকেরা বন্য পশুদের তাদের চারণভূমিতে অবাধে চলাচল করতে দেবে। এদের নিয়ে ব্যবসা বাণিজ্যে অনেক কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করবে। মানব ও প্রাণীজগতের যোগাযোগ হ্রাস করবে। পুরো বিশ্ববাসী ঘন ঘন হাত ধুবে। নিয়ন্ত্রিত ভাবে সামাজিক শিষ্টাচার মেনে হাঁচি এবং কাশি দিবে। ঘরে ঘরে হ্যান্ড স্যানিটাইজার থাকবে।

একটা পর্যায়ে এসে দেয়ালে যখন পিঠ ঠেকে যাবে, সমস্যা সংক্রমনের মাঝেই জীবন চলতে শুরু করবে জীবনের ছন্দে। জীবন তার স্বাভাবিক পথ অনুসরণ শুরু করবে। কারো কারো জীবনের রথ থেমে যাবে মহামারির বিপর্যয়ে। বিশ্ব কতৃপক্ষ সংকট মোকাবেলায় নতুন পথ খুঁজে বের করবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার উদ্যোগ কার্যকরে আরো কঠিন পদক্ষেপ নিবে। হয়তো এক দ্বিধাবিভক্ত বিশ্বের সৃষ্টি হবে। এ সমস্যায় অকার্যকর, উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এবং অব্যবস্থাপনার দেশগুলোর নাগরিকদের যে দেশগুলো কার্যকরভাবে করোনাকে নিয়ন্ত্রন করতে সক্ষম হয়েছে সেই দেশগুলোতে প্রবেশ করতে দিবেনা। তাদের জন্য কঠিন বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে। ফলে প্রথোমক্ত দেশগুলোতে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাবে। সুতরাং, দরিদ্র এবং দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী দেশগুলি এই রোগের ব্যাপক সংক্রমণের মাধ্যমে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাবে।

যদি করোনার সংক্রমন অব্যাহত থাকে এবং এটি যদি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিস্তৃত সকল পরিসরে মানুষের পদচারনা থামিয়ে দেয়, মানুষের আয় অতি সীমিত করে ফেলে, তবে বেশির ভাগ মানুষ বিলাসি আয়েসি জীবন ছেড়ে স্বাস্থ্য, সুস্থতা নিয়ে নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করতে চাইবে। ব্যবসার প্রকৃতি পাল্টে যাবে। সুপিরিয়র পণ্যগুলি ভাত ডাল রুটি দ্বারা অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রতিস্থাপিত হবে।

অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী বিশ্বের বৃহত্তম দেশগুলোর বানিজ্য আত্নকেন্দ্রিক হয়ে যেতে পারে। বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং অটোমোবাইল খাতের সরবরাহ শৃঙ্খলে বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে। আউটসোর্সিং হ্রাস পাবে। মূল উপাদানগুলির ঘাটতি মেটাতে নিজ নিজ দেশে নতুন কারখানা তৈরি হবে। এই কারনে বিশ্বায়নের বিপরীত স্রোত প্রবাহিত হবে । কর্পোরেট এবং জাতীয় উভয় স্তরে একে অপরকে সহযোগিতা করার বিষয়টি হ্রাস পাবে। শেষ পর্যন্ত বিশ্ব অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি বিচ্ছিন্ন হবে। ক্ষেত্র বিশেষে গভীর সংকটে পড়ে অনেক কারখানা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এভাবে করোনাভাইরাস সব ধরনের ব্যবসায়ে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে।

সাইবার-ফিজিক্যাল-বায়োলজিক্যাল সিস্টেম এর যৌথ ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্ব এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব গ্রহণ করছে। এমমনিতেই শিল্প ও ওয়্যারহাউসগুলো ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতার দৌড়ে টিকে থাকার জন্য তাদের কর্মক্ষেত্র গুলোকে মানুষমুক্ত করার জন্য উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। শিল্পে ইনটেলেক্টুয়াল ক্যাপ্টেনরা রাজত্ব করতে থাকবে। উপার্জন মূলত বুদ্ধিজীবীদের এই নতুন ব্রাহ্মণ সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। তাদের নীচে পড়ে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী অবশ্যই তাদের চাকরি হারাবে। সর্বোপরি উল্লেখযোগ্য হারে মজুরি হ্রাস পাবে।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম রিপোর্ট করেছে যে বিশ্বজুড়ে ৪০০-৮০০ মিলিয়ন মানুষ অটোমেশন দ্বারা চকুরীচ্যুত হতে পারে। এটি চাকরির বাজারকে ক্রমবর্ধমানভাবে ‘স্বল্প দক্ষতা, স্বল্প বেতন’ এবং ‘উচ্চ দক্ষতা, উচ্চ বেতন’ভিত্তিতে বিভক্ত করবে। যার ফলস্বরূপ সামাজিক বৈষম্য ও অস্থিরতা বাড়বে। এছাড়াও কিছু কারিগরী কৌশল দক্ষতা একেবারে অচল হয়ে যাবে। যাঁরা তাঁদের চাকরি হারাবে তাদেরকে কীভাবে চাহিদা মোতাবেক পুনরায় যুগোপযোগী কাজে প্রশিক্ষিত করা যাবে এবং কীভাবে আমরা তাদের বেঁচে থাকার জন্য একটা নতুন উদ্দেশ্য, কাজ এবং মজুরি দেব, সেগুলি সামনের দিনগুলিতে একটা বড় চ্যালেঞ্জ হবে। করোনার পরিস্থিতি তা আরও ভয়াবহ করে তুলছে। অপেক্ষাকৃত অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশ বলে বসে থাকলে হবেনা। সরকার এবং নীতি নির্ধারকদেরে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে নানা উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে।

কোন রোগের ভয় ঐ রোগের মধ্যেই শুধু সীমাবদ্ধ থাকেনা। এটি জীবনের যে কোনও ক্ষেত্র বা পরিধির সাথে ক্রস-মিক্স হতে পারে। এটি মানবসমাজকে বিশ্বায়নের পরিবর্তে ঘনিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন , পবিত্র পারিবারিক বন্ধন অটুট , জাতীয়তাবাদে উদ্দীপ্ত এবং যৌন বিচক্ষণতা সংরক্ষন করতে অনুপ্রাণিত করে। নৈতিক কাজ এবং নৈতিক বিনোদন করা মানুষের আদর্শ হয়ে উঠতে পারে। একইভাবে মানুষজন ধর্মনির্ভর হয়ে পড়তে পারে। কারন ধর্ম আধ্যাত্মিক প্রযুক্তি পদ্ধতি প্রদান এবং তা অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষকে কষ্ট অসুবিধা সহ্য করতে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে, সর্বোচ্চ ঝুঁকির মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে সহনশীল ও আশাবাদী করে তুলতে পারে। সর্বেপরি মানুষকে কর্মের দিকে পরিচালিত করতে সহায়তা করে।

সামনের দিনগুলোতে পুরো বিশ্ব এক চরম অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে যাবে। করোনা খনিতে শ্রমিকদের বয়ে নিয়ে যাওয়া ক্যানারি পাখীর মতো সতর্কতা জারি করছে। অশনি সংকেত দিচ্ছে। করোনার কারনে আগামী কয়েক বছরে প্রত্যেকের আয়ের পরিমান প্রচন্ডভাবে নিম্নমুখী হবে। এবং এটা অনিবার্য। সামাজিক শৃঙ্খলা কী হবে, আমরা এখনও তা জানি না, এবং এ বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষমও নই।

COVID-19 আমরা কতটা স্বার্থপর হতে ইচ্ছুক তার একটা স্ট্রেস টেস্ট নিচ্ছে। এখন আমাদের প্রায় সবাইকে এ সংকট প্রভাবিত করছে। যার মধ্যে কারও কারও চরম স্বার্থপরতা আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে। আমাদের একসাথে কাজ করতে হবে। COVID-19 মোকাবেলায় আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত উদ্যোগ অনেকটা সরকারের পদক্ষেপ এর মতোই গুরুত্বপূর্ণ। তা কোন অংশে কম নয়। এবং তাতে কোন সংশয় নেই। মানুষদের সুচিকিত্সার বিষয়টি বিশেষজ্ঞদের দ্বারা দ্ব্যর্থহীনভাবে নিশ্চিত করতে হবে। সমাজের সকল শ্রেনী পেশার মানুষ একে অপরকে সহযোগিতায় আন্তরিক হতে হবে।

প্রকৃতপক্ষে, দরিদ্র লোকেরাই ধনী ব্যক্তিদের চেয়ে তাদের উপার্জনের বেশিরভাগ অংশ হারাবে। আয়, ব্যয় এবং খরচ ক্রমবর্ধমানভাবে ডিজিটাল হয়ে গেছে। গিগ অর্থনীতি সহজ কথায় ছুটা কাজ, চুক্তিভিত্তিক কাজ বা ফ্রিল্যান্সিং ইতিমধ্যে শ্রমবাজার দখল করছে। ভবিষ্যতে আরও বেশি পরিমানে তা শ্রমবাজার দখল করবে। সবচেয়ে করুন বিড়ম্বনার নিদারুন দুঃখের বিষয় হবে যে, এই সংকটে যাদের হাতে কোন কাজ থাকবেনা তারা কতোটা অসহায় হয়ে যাবে তা স্বার্থপরের মতো চেয়ে চেয়ে দেখা।

ধনী ব্যক্তির বা চিকিৎসকের বা রাজনীতিবিদের কুৎসা রটনা করা অনেকটা সামাজিক অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। ব্যক্তিবিশেষের মনগড়া বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপাতত ধর্মের প্রসঙ্গে যাচ্ছিনা। তারা অন্তত মার্কিন মনোবিজ্ঞানী মাসলোর মোটিভেশন থিউরি অনুযায়ী এমন মূল্যবোধ দ্বারা অনুপ্রাণিত হতে পারেন যে নিজ আত্নার উন্নয়নে পরোপকার বা পরার্থে কিছু করতে পারেন। আমাদের চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, ব্যক্তিবর্গ ও রাজনীতিবিদদের যারা এই ঘোর বিপদের ভিক্টিমদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন, আক্রান্তদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন তাদের সকলকে সালাম জানাই।

‘ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি, রাম-লক্ষণ সাথে আছে, করবি আমার কি?’ ভূতে বিশ্বাস না করলেও, ছোটবেলায় অন্ধকার রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় — শরীর হিম হয়ে যাওয়া গা ছমছম করা ভয়কে তাড়াতে অনেক শিশুই এ ছড়া আওড়িয়েছে। লক্ষ্য করলে দেখা যায় জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ এর গল্প-উপন্যাসের নামগুলো খুবই সুন্দর ও আকর্ষনীয়। অধিকাংশ গল্প উপন্যাসের ভাষা বিষয়বস্তু যতোটা সহজ সরল আর প্রাঞ্জল নামটা ঠিক ততোটা কঠিন দুর্বোধ্য। যেমন অয়োময়, বহুব্রীহি, নিরন্তর, নন্দিত নরকে, আগুনের পরশমণি, দুই দুয়ারী, শঙ্খনীল কারাগার আরো কতকি। তেমনি তাঁর ভৌতিক গল্পগ্রন্থ ‘ভূত আমার পুত’ এর নামকরন সম্ভবত এই ছড়া থেকেই হয়েছে। পৃথিবীতে প্রত্যেকটি মানবশিশু একইভাবে জন্ম নেয়। তারপর নিজ নিজ দেশের নিয়মানুযায়ী তার অভিভাবকরা তার জন্মসনদ নিয়ে থাকেন। তাতে তার জাতীয়তা নির্ধারিত হয়। বড় হওয়ার সাথে সাথে সে পরিবার থেকে ধর্মীয় বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে। ধর্মীয় অনুশাসনের সাথে পরিচিত হয়। অতঃপর অতি আগ্রহী শিশুরা পবিত্র ধর্মগ্রন্থ সমূহ পাঠে আরো অধিকতর জ্ঞান লাভ করে। সুভাগ্যবান কেউ কেউ ধর্মভীরু হয়। আবার কেউ নামসর্বস্ব হয়ে পড়ে। ঠিক তেমনি নানারকম পারিবাকি, সামাজিক, দেশীয় সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের সাথে তাদের পরিচিত হয়।

অতএব ছোটবেলা থেকেই আমরা কোন না কোন ধর্মবিশ্বাস নিয়ে বড় হচ্ছি। নানারকম ভুত-প্রেত, ডাইনী, রাক্ষস-ক্ষোক্কস এর গল্প শুনে বড় হচ্ছি। বড় হতে হতে কেউ কেউ এইসব ভুত-প্রেত এর অস্তিত্বই আর স্বীকার করিনা। আবার কেউ কেউ আমৃত্যু ধর্মের উপর নির্ভরতা বা বিশ্বাস একেবারে মন থেকে ঝেড়ে ফেলে।

ছোটদের মতো বিপদ-আপদ থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য বড়দের আওড়ানো স্তবগান বা স্তুতির দু একটি বুলির উল্লেখ করছিঃ “Agni from eastward guard me with the Vasus! To him I go, in him I rest: this fort I seek for refuge. /May he protect me; may he be my guardian.’।” এবং “And dangers affright;/Though friends should all fail, /And foes all unite, /Yet one thing secures us, /Whatever betide:/The Scripture assures us, / “The Lord will provide.” ।

অথবা পরম বিশ্বাস ও ভক্তি ভরে আওড়ানো বুলি অনেকটা এইরকম হয়ঃ “The birds, without barn/Or storehouse, are fed;/From them let us learn/To trust for our bread;/His saints what is fitting/Shall ne’er be denied,/So long as ’tis written,/“The Lord will provide.”…/ faith makes us bold;/For though we are strangers,/We have a good Guide;/And trust in all dangers:/“The Lord will provide.”। And death is in view,/ The word of His grace/Shall comfort us through;/ Not fearing or doubting,…/We hope to die shouting,/“The Lord will provide.”

অনেককেই ভারী কাজে যেমন বড় গাছের গুড়ি ঠেলতে গিয়ে ‘ইয়া আলী’ বলে মনে শক্তি ও সাহস আনতে দেখি। গল্প, নাটক, সিনেমাতে “ইয়া আলি, মাদাদ আলি” গানটি প্রচুর শুনেছি। কেউবা নোঙ্গর তুলে হাওয়ার বুকে নৌকা ভাসাতে হেইয়া রে, হেইয়া হো বলে গান গাইছেন।

ইরাকের নিনেভা প্রদেশের লোকজন তাঁর ডাকে সাড়া না দেওয়ায় তাদের সাথে রেগেমেগে আল্লাহতা’লার বিনানুমতিতে স্বদেশ ত্যাগ করেছিলেন হজরত ইউনুস (আ.) । অতঃপর আল্লাহ তাঁকে পাকড়াও করেন। হজরত ইউনুস (আ.) ঘটনাক্রমে সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হলে একটি প্রকাণ্ড মাছ তাকে গিলে ফেলে। মাছের উদরের সেই নিকষকালো অন্ধকারে ৪০ দিন ভীষণ কষ্টের মধ্যে থেকে তিনি কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা ব্যক্ত করেন। অত্যন্ত সম্মান, বিনয় ও কাতর স্বরে বলছিলেন ‘হে আল্লাহ! তুমি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, তুমি মহাপবিত্র। নিশ্চয়ই আমি সীমা লঙ্ঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত।’ আল্লাহ তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। নবী ইউনুসের প্রার্থনা মঞ্জুর করেছিলেন। বৃহদাকার ওই মাছ তাকে হজম করতে সমর্থ হয়নি। এমনকি তাঁর দেহের সামান্যতম অংশেও কোনোরূপ ক্ষতের সৃষ্টি করতে পারেনি। এবং মাছটি তাকে সমুদ্রের কিনারে উগরে দেয়। আল্লাহর একত্ব ও অদ্বিতীয়ত্ব, তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা এবং নিজের অপরাধের স্বীকারোক্তি সম্বলিত উপরোক্ত তিনটি বাক্য বারংবার পাঠ করেই আল্লাহর রহমতে মাছের পেট থেকে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন। আর আমাদের জন্য শুভসংবাদটি ছিলো এইরকমঃ আর এভাবেই আমি আল্লাহ মুমিনদের (বিশ্বাসীদের) উদ্ধার করে থাকি।

মজার ব্যাপার হচ্ছে যে, অধুনা আমরা যে কোয়ারেন্টিন বা সঙ্গরোধ কাল শব্দটি শুনছি তার উৎপত্তি হয়েছিলো — ইতালিয়ান শব্দ ‘quaranta giorni’ বা ‘কোয়ারান্টা জিওরনি (ক্ষমা করবেন, সঠিক উচ্চারনটি আমি জানিনা) যার অর্থ হচ্ছে ৪০ দিন — থেকে। ইতালির উপকূলীয় শহরগুলিকে প্লেগের মহামারী থেকে রক্ষা করার প্রয়াসে চৌদ্দ শতকে সেখানে কোয়ারেন্টিনের অনুশীলন শুরু হয়েছিল। ইতালীর বিভিন্ন বন্দরে আসা জাহাজগুলোকে নোঙ্গর করার পর কাউকে জাহাজ থেকে ৪০ দিন নামতে দেওয়া হতোনা তখন।

পৃথিবীতে চলার পথে নানান ধরণের বিপদ-আপদ, অসুখ ও সমস্যার সম্মুখিন হতে হবে মানুষকে। বিপদ-আপদ মানুষের নিত্যসঙ্গী। কখন কার ওপর সমস্যা, দুর্বিপাক নেমে আসবে তা কেউ জানে না। বিপদ বা সঙ্কটে পড়লে আমরা বেশিরভাগ মানুষই হতবিহ্বল হয়ে যাই। মানুষের চিন্তা-ভাবনা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। দিশেহারা হয়ে করণীয় ভুলে যাই। নিনেভার ঘটনা আমাদেরকে নিশ্চয়ই এই শিক্ষা দেয় যে, বিপদে পড়লে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হয়। সবকিছুতেই একমাত্র আল্লাহর উপরেই ভরসা রাখতে হয়। তিনিই একমাত্র উদ্ধারকারী। তিনি চাইলে মুহূর্তেই বিপদ থেকে মুক্তি দিতে পারেন। পেরেশানির কুহেলিকা হটিয়ে দিতে পারেন। সব বিপদের রক্ষাকর্তা একজন, মহান আল্লাহ।

পবিত্র কোরআনে কারিমের দুটি সূরার একটির নাম সূরা ফালাক এবং অন্যটির নাম সূরা নাস। এখানে আলোচনার সুবিধার্থে সূরা ফালাকের বাংলা অর্থ উদ্বৃত করছি: ‘দয়াময় মেহেরবান আল্লাহর নামে। (হে নবী! তুমি) বলো, আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি প্রভাতের স্রষ্টার। আশ্রয় গ্রহণ করছি তাঁর সৃষ্টির অনিষ্ট থেকে, রাতের অন্ধকারের অনিষ্ট থেকে, গ্রন্থিতে ফুৎকারদানকারী ডাইনিদের অনিষ্ট থেকে, হিংসুকের হিংসার অনিষ্ট থেকে।’

এই দুই সূরার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সব ধরনের অনিষ্ট থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনার কথা বলা হয়েছে। আর আল্লাহতায়ালা এই দুই সূরার মাঝে সব অনিষ্ট থেকে হেফাজতের অসীম শক্তি ও প্রভাব রেখেছেন। (ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি) বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম এর প্রথম আরবী বর্ণের নাম ‘বাʾ আর সূরা নাসের শেষ বর্ণ সীন্ এর বাংলা উচ্চারণ ‘স’ একত্রিত করে লিখে উচ্চারন করে বলা যায় ‘বাস্, ইহাই যথেষ্ট’।

এমনিতে আমরা সবাই তো দিব্যি আছি। এতসব কিছু বোঝার কি আদৌ দরকার আছে? বিচার-বুদ্ধি-প্রজ্ঞাহীন আমি এসব কী বলছি? কেনই বা বলছি? এসব বলে কী লাভ? এসব পড়ে আসলে কতখানি লাভ? এ সব প্রশ্নই আমাদেরকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। কোরআন শরীফের প্রথম শব্দ হলো ‘ইকরা’ — তুমি পড়ো। ধরে নিই এটা আমাদের প্রতিও একটা নির্দেশ ছিল।

করোনা আমাদেরকে শিখিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছে — অফিসের মালি থেকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, সাধারণ প্রজা থেকে গ্রেট ব্রিটেনের মহারানী, ধনী থেকে গরীব শেষ বিচারে আমরা সবাই মানুষ। যত বিত্তশালী প্রভাবশালী হইনা কেন এই ক্রান্তিকালে আমরা সকলে একই রকম অরক্ষিত। তাহলে পড়েই দেখিনা।

মহান সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ মতো তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করি। বাস্তবে শক্ত করে আঁকড়ে ধরি তাঁর নির্ভরযোগ্য আশ্রয়৷ আর যাবতীয় বিষয়ের শেষ সমাধান রয়েছে নিশ্চয়ই আল্লাহরই কাছে৷ পাশাপাশি এই ক্রান্তিলগ্ন অতিক্রমের জন্য মনোবল অটুট রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি।

এসব করছি। লাভ হচ্ছে না। লাভ হয়না। হবেওনা -এ সব উত্তর ইতিমধ্যে আমার মনেই উঁকি দিচ্ছে। পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ মতে আগেও লোকেরা বুদ্ধি-জ্ঞানের অধিকারী ছিল। নবী আইয়ুব (আ) এর ভাগ্নে এবং নবী দাউদ (আ) এর সমসাময়িক ছিলেন মহাজ্ঞানী লুকমান। তাঁর জ্ঞান্তগরিমার কাহিনী বহুল প্রচলিত। তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত উপদেশ ও জ্ঞানগর্ভ বাণী জনগণের মাঝে খ্যাতি অর্জন করেছিল এবং প্রজন্মান্তরে আলোচিত হয়ে আসছিল। কথাবার্তায় তাঁর প্রবাদ বাক্য ও জ্ঞানগর্ভ কথা উদ্বৃত হয় এখনো। তিনি নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা দিতেন। হজরত লোকমান হাকিম (রহ.) নবী ছিলেন না। একজন পুণ্যবান, মুত্তাকি ওলি ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব ছিলেন। মহান আল্লাহতা’লা তাঁকে উচ্চস্তরের জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক, দূরদর্শিতা ও অভিজ্ঞতা দান করেছিলেন। মহান আল্লাহ সেসবের একটা অংশ পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করে তার মর্যাদা আরও বৃদ্ধি করে দিয়েছেন। লোকমান (আ) এর উপদেশ: বিপদাপদে সবর কর। নিশ্চয়ই এটা সাহসিকতার কাজ। ধৈর্যশীলতা বিপদে সাহস ও ভরসার হিসেবে কাজ করে।

বিজ্ঞানী জন ক্যালহুন ইঁদুর নিয়ে গবেষণা চালিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন, ইঁদুরের স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ বসবাস ও বিচরণের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার তুলনায় তাদের সংখ্যা অত্যধিক বেড়ে গেলে তাদের মধ্যে সামগ্রিক আচরণগত বিপর্যয় ঘটে। তখন তারা পরস্পরকে কামড়ায়, দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে, কারণে-অকারণে অশান্তি সৃষ্টি করে। কিছু পুরুষ ইঁদুর ভীষণ হিংস্র হয়ে ওঠে। তারা মেয়ে ও বাচ্চা ইঁদুরদের অকারণে আক্রমণ করে। শেষ পর্যন্ত তারা আর সুস্থ-স্বাভাবিক ইঁদুরের মতো আচরণ করতে পারে না।

জনঘনত্বের জন্য ক্যালহুনের ইঁদুর-সমাজের এই চিত্র মানব-সমাজের জন্য খুব একটা খাটে না। জনঘনত্ব খুব বেশি হলেই মানুষের মধ্যে হিংস্রতা, হানাহানি বেশি হবে, এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যেমন নেদারল্যান্ডসের জনঘনত্ব আমেরিকার চেয়ে ১৩ গুণ বেশি। সেই হিসাবে নেদারল্যান্ডসে খুনোখুনিসহ বিভিন্ন সহিংস অপরাধের মাত্রা আমেরিকার তুলনায় অনেক বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তার উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। আমেরিকায় মানুষ হত্যা ও অন্যান্য সহিংস অপরাধ নেদারল্যান্ডসের তুলনায় অনেক অনেক বেশি।

খুন, ধর্ষণ ও অন্যান্য সহিংস অপরাধের সঙ্গে জনঘনত্বেরে একেবারে কোন সম্পর্ক নেই, তা-ও বলা যাবেনা। জনঘনত্ব বেশি হলে মানসিক চাপ বেশি হয়। এটা নিয়ে অবশ্য তেমন বিতর্ক নেই। আর স্ট্রেস বেশি হলে মানুষের আচরণগত অবনতি ঘটতে পারে। এমন কথা বিজ্ঞানীরা বলেন। তবে জনঘনত্বের মানসিক চাপ বিভিন্ন সমাজ বিভিন্নভাবে সামলে নিতে পারে।

কোন সমাজ কীভাবে সামলায়, তা নির্ভর করে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, আইনি ও বিচারিক ব্যবস্থা, ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, সামাজিক রীতিনীতি ইত্যাদির ওপর। ইউরোপের বিভিন্ন শহরে জনঘনত্ব অনেক বেশি। কিন্তু তাদের ট্রাফিক ব্যবস্থা ও জনসমাবেশের জায়গাগুলো বেশ সুশৃঙ্খল। হংকং, সিঙ্গাপুর বা টোকিওর মতো জনবহুল শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা, জনশৃঙ্খলা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সামগ্রিক সৌন্দর্যের সঙ্গে ভারতের মুম্বাই বা আমাদের ঢাকা শহরের তুলনাই করা যায় না।

পৃথিবীর সর্বাধিক জনবহুল দুই দেশ চীন ও ভারতের জনঘনত্ব বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম। খুব ছোট্ট একটি ভূখণ্ডের মধ্যে আমরা প্রায় ১৭ কোটি মানুষ বাস করছি। খেয়ে-পরে বেঁচে আছি বললে কমই বলা হবে। বরং আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে, স্বাস্থ্য ভালো হচ্ছে, আয়ু বাড়ছে। তবে কেন আচরণগত সমস্যার লক্ষণ ধরা পড়েছে। অতিরিক্ত জনঘনত্ব বাদে নৈতিকতার অবক্ষয়ে অতিরিক্ত বিত্ত ক্ষমতার মোহে লোভ লালসায় আমাদের অবস্থা কিছুটা হলেও ইঁদুরদৌড়ের মতোই। আর অতি সাধারণেরাতো এমনিতেই জীবনযুদ্ধে মৌলিক চাহিদা পূরণে সারাদিন দৌড়ের উপরই থাকে।

মনের ভেতরে যে পার্থিব চিন্তাগুলো চলতে থাকে তাতে আমরা নিমগ্ন থাকি। সারাদিনের নানা অসহ্য ঘটনা, নানা মানুষের নানান কটু কথা, হাজারো দুশ্চিন্তা আমাদের একাকী মনে নিজর্নে ভর করে থাকে। সবকিছুর জন্য সঠিক প্রস্তুতি নেয়া চাই। কলুষিত মন পরিস্কার করে সম্পূর্ণ মনোযোগ আনা চাই। প্রতিদিন কয়েকবার কিছু গদ বাঁধা কথা বলে পড়ে কী সত্যিই কোন লাভ আছে? সর্বান্তকরনে বিশ্বাস করি অবশ্যই আছে। অনেকেই বলছে প্রভুর সাথে কথা বলার এটা একটা উপায়। জীবনে যত আনন্দ, যত সুখ, যত কিছু পেয়েছি — তার জন্য তাকে বিশেষ ভাবে ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানানোরে এটা একটা উপায়। ধর্মমতে যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে তাঁর কৃতজ্ঞতা হবে তাঁর নিজেরই জন্য লাভজনক৷

একবার নিজেই অনুশীলন করি, নিজেই উপলব্ধি করে দেখি কি হয়? আল্লাহর সাথে নিজের ভাষায় মনে মনে কথা বলি। তারপর আমাদের যত দুঃখ-কষ্ট, মনের মধ্যে চেপে রাখা যত অভিযোগ, যত ক্ষোভ — সব আল্লাহকে বলে দিই। সিরিয়ার ছোট্ট সেই মেয়েটি ঠিক বুঝেছিল। বলেছিল ‘আমি আল্লাহর কাছে সব বলে দিব।’অসম্ভব অভিমানে মরে গিয়েছিল সেই সিরীয় শিশু। আল্লাহ অবশ্যই সবকিছু শুনেন এবং তাঁর মতো করে আমাদেরকে সমাধান দেন। মানুষের কাছে ঘ্যান ঘ্যান না করে, ফেইসবুকে দীর্ঘশ্বাস না ছেড়ে, নিজেদের সব সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়ার কথা শুধুই বিশ্ব জগতের সর্বোচ্চ ক্ষমতার সামনে পেশ করি। একমাত্র তিনিই পারেন আপনার আমার ভাগ্য পরিবর্তন করে দিতে।

আমরা ও আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম চরমভাবে ‘বিনোদনাসক্ত’হয়ে পড়ছি। নিজেদেরকে বিনোদনে বুঁদ করে রাখতে না পারলে আমাদের ডিপ্রেশন চলে আসে। ভালো কিছু চিন্তা করার জন্য মস্তিস্কের কোনো ক্ষমতা অবশিষ্ট রাখছিনা। আমরা যদি ঠিকমত ধর্মীয় রীতি-নীতি, কর্মপদ্ধতি মেনে পবিত্র দেহ ও মনে প্রার্থনা করি তা জোরালো হবে। হালাল খাদ্য , হালাল পানীয়, হালাল পরিধেয় বস্ত্র, হালাল উপার্জন মনে শক্তি আনে। প্রার্থনা মন্জুর হওয়ার জন্য জন্য আল্লাহর স্মরণ ও তার রসূল (সা.) এর উপর দরুদ ও সালাম জানানো খুব ফলপ্রসূ। বিশ্ববাসী আজ করোনার শিকার হয়ে শারীরিক বা মানুসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। আর অসুস্থ ও অসহায় লোকদের প্রার্থনা তিনি আল্লাহ অবশ্যই মন্জুর করবেন।

প্রথম মানব মানবী স্বর্গ থেকে স্হানচ্যুত হয়ে পৃথিবীতে এসে তাঁরা তাঁদের কৃতভুলের কথা স্মরণ করে আল্লাহর দরবারে রোনাযারি করতে থাকেন। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাদেরকে প্রার্থনাবাণী শিখিয়ে দেওয়া হল। তারা বললেন: “হে আমাদের প্রতিপালক, আমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করেছি, যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন তবে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অর্ন্তভুক্ত হব।”হজরত নূহ (আঃ) আশ্রয় চেয়েছিলেন এইভাবেঃ “হে আল্লাহ, আমি অসহায়। অতএব আপনি প্রতিবিধান করুন।” হজরত মূসা (আঃ) প্রার্থনা করেছিলেন “হে প্রভু আমি নিজের উপর জুলুম করেছি। অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন।”

মানুষ প্রতিনিয়ত নানা রকম দঃখ, কষ্ট, ক্লেশ, পেরেশানি, দুশ্চিন্তা ও জটিল বিষয়ের সম্মুখীন হয়ে পড়ে। তখন বিশ্বাসীরা আশ্রয় নেয় আল্লাহর রহমতের ছায়ায়। ইতালির প্রধানমন্ত্রী জুসেপ্পে কন্তের কণ্ঠে এই রকম একটা সুরই বেজে উঠেছিল। তাই টুইটারে তিনি বলেছেন, ‘আমরা সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি। আমরা শারীরিক ও মানসিকভাবে মারা গেছি। আর কী করতে হবে তা আমরা জানি না। পৃথিবীর সমস্ত সমাধান শেষ হয়ে গেছে। এখন একমাত্র সমাধান আকাশের কাছে। তার এ বক্তব্য বিশ্ববাসীকে নাড়া দিয়েছে।’ মনে হচ্ছে, বিশ্বাসের ঘাটতিতে তিনি আকাশকে সম্বোধন করছেন।

আল্লাহর রহমতের ছায়া পড়ে আছে আল্লাহর নানা সিফাতি বা গুণবাচক নামের তাৎপর্যের মধ্যে। আল্লাহ সুবহানাহু তাআলার ৯৯টি গুণবাচক নাম রয়েছে। আল্লাহ তাআলার সুন্দরতম ও অর্থবোধক এসব নাম নিয়ে দোয়া করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর সুন্দরতম নামের নিয়মিত চর্চা করতে হবে। যে বান্দা এ গুণগুলো ধারণ করার চেষ্ঠা করে, সে অবশ্যই সফলকাম হবে। আমাদেরও উচিত এ সব নাম জানা এবং আল্লাহর গুণবাচক নামের অর্থে রঙিন হওয়া।

প্রার্থনা এবং সৃষ্টিকর্তার স্মরন উভয়ই এমন কিছু অনুশীলন যা মস্তিষ্কের গতিশীলতা তৎপরতা বৃদ্ধি করে। নিজের মধ্যে সুপ্ত থাকা আল্লাহ প্রদত্ত সৎগুণাবলী এবং শক্তির প্রকাশ সহজ করে। আল্লাহর সুন্দর নামে নিহিত গুণাবলীর কিছুটা হলেও আমাদের মস্তিষ্কে আপন বৈশিষ্ট্য হিসাবে প্রকাশিত হয়। আমরা যখন মনে মনে অবিচ্ছিন্নভাবে আল্লাহর সুন্দর নামগুলির পুনরাবৃত্তি করি, এই নামগুলিতে নিহিত সদৃশ গুণের সক্ষমতা আমাদের মধ্যে আরো ভালভাবে প্রকাশ হতে মস্তিষ্ককে উত্সাহিত করে।

উদাহরনস্বরুপ বলা যায় — ধূমপান, নেশা পানীয় বা মাদকাসক্তি ছাড়তে পারছিনা। আল কুদ্দুস — নিখুঁত ও পবিত্র নামটি পুনরাবৃত্তি করি। চরম অশান্তিতে আছি। অসুস্থ আছি। আস-সালাম অর্থ: নিরাপত্তা-দানকারী, শান্তি-দানকারী — এই নামটি বার বার নিজে পড়ি। মনে শান্তি আসবে। আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয়ই শান্তি দিবেন। সুস্থতা দান করবেন। রোগ হতে আরোগ্য করবেন। সূরা ইয়াসীনকে বলা হয় কোরআনের হৃদপিণ্ড। এর আয়াত ৫৮ এর বাংলা অনুবাদ — অসীম দয়ালু রবের পক্ষ থেকে বলা হবে, ‘সালাম’। আল-মুহাইমিন অর্থ: তত্ত্বাবধায়ক, পর্যবেক্ষক, সংরক্ষক। সর্বদা পড়লে সব বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

মনে স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন আসতেই পারে এটি কতোটা বিজ্ঞানসম্মত। পরীক্ষামূলকভাবে অবিরত অনুশীলন চালিয়ে অবিশ্বাসীরাও ফল পেয়েছেন। কারণ, এই অনুশীলন সম্পূর্ণ প্রযুক্তিগত প্রক্রিয়া। কারও বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে না। এটি অগণিত পরীক্ষায় পর্যবেক্ষণ করে দেখা হয়েছে। মস্তিষ্কে নির্দিষ্ট অর্থ বহনকারী শব্দগুলি পুনরাবৃত্তি করার মাধ্যেমে মস্তিষ্ক সেই রকম অনুভূতি সৃষ্টি করে। এটি একটি অনুশীলন। এটি সময়, স্থান কিংবা বিশ্বাস দ্বারা আবদ্ধ হয় না। মস্তিষ্ক, হৃদপিণ্ডের অনেক ক্রিয়া-প্রক্রিয়া বৈদ্যুতিক সংকেত দ্বারা পরিচালিত হয়। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত “মিস্ট্রি অফ ম্যান” বইয়ে বলা হয়েছে, মস্তিষ্কের কোষগুলোর বৈদ্যুতিক সক্রিয়তা পুনরাবৃত্ত শব্দের অর্থের সাথে মিল রেখে বৃদ্ধি হয়। এবং উক্ত অর্থ অনুযায়ী কর্ম-নির্দেশনা প্রদান করে।

পরবর্তিতে পরীক্ষাগারে আরো অনুসন্ধানে প্রমানিত হয়েছে যে, আল্লাহর সুন্দরতম নামের নিয়মিত চর্চা, পুনরাবৃত্তি মস্তিষ্কের নিষ্ক্রিয় অঞ্চলের সাথে সাথে সুপ্ত স্নায়ু সমূহকে নতুন করে উজ্জীবিত করে। স্নায়বিক ক্রিয়াকলাপ বাড়ায়। ১৯৯৩ সালে “সায়েন্টিফিক আমেরিকান” এর একটি নিবন্ধ এ বিষয়ে গবেষণার ফলাফল প্রথমবারের মতো প্রকাশ করে। নিবন্ধে এটা স্বীকার করা নেয়া হয় যে, পরীক্ষাগারে বিষয়গুলো নিয়ে সুদীর্ঘ বছর নিবিড় গবেষণা ও পরীক্ষা চালিয়ে এ সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছেন তাঁরা। উপসংহারে বলা হয়েছে: “যখন কোনও ব্যক্তি সুন্দরতম নাম বারবার পড়েন, তখন মস্তিষ্কের বিভিন্ন নিষ্ক্রিয় অঞ্চল এবং সুপ্ত নিউরাল গ্রুপ জড়িত হয় এবং সক্রিয় হয়ে ওঠে। যাতে মস্তিষ্কের কার্যক্ষম ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।”

নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট ক্ষণে নির্দিষ্টবার আল্লাহর প্রদত্ত নামগুলি পুনরাবৃত্তি করলে আমাদের মস্তিস্কের ক্ষমতা বাড়বে। সেই উত্তম গুনবাচক নাম সমূহ আমাদের ব্যক্তিত্বকে উন্নত করতে সহায়তা করবে। আপনি বা আমি বিশ্বাস করি বা না করি তাতে কিছুই আসে যায় না। ফলাফল একই থাকবে যদিনা আমরা আমাদের নৈতিক মূল্যবোধের কোন অবক্ষয় না ঘটাই। আর বিশ্বাস মনে নিয়ে আসে শক্তি,সাহস আর আত্নবিশ্বাস। এবং ফল হিসেবে চুড়ান্ত সফলতা।

প্রার্থনা মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক-তরঙ্গকে পরিচালিত করার একটি ক্রিয়া। অতি বস্তুবাদী, বাস্তববাদী, সাধারন দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ আমরা। তাই মনে করি ঠোঁট সঞ্চালনে, হেঁটে হেঁটে, সাইকেলে প্যাডেল মেরে, বাইক দিয়ে, গাড়ি চড়ে, উড়োজাহাজে উড়ে, ফেসবুক চালিয়ে বা চিঠি পত্রের মাধ্যমে আমরা একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারি। আসলে, যোগাযোগ মস্তিষ্কের মধ্যে একটি মিথস্ক্রিয়া। সাধারণত মিথস্ক্রিয়া বলতে দু’টি ভিন্ন বস্তুর মাঝে পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া কিংবা বিনিময়কে বুঝায়।

রসায়ন বা পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায় দুটি বস্তুর মধ্যে একটি কোনো কিছু (যেমন- ইলেকট্রন) ত্যাগ করলে এবং অপর কোনো বস্তু তা গ্রহণ করলে তাদের মাঝে মিথস্ক্রিয়া ঘটছে বলা যায়। আর জায়া-পতি, কপোত-কপোতি, প্রেমিক-প্রেমিকা অর্থাৎ ভালোবাসার মানুষেরাতো এখনো নিজেদের মাঝের কেমিস্ট্রি মানে রসায়নই এখনও বুঝে উঠতে পারছেনা। তাইতো এতা বিচ্ছেদ- বিরহ-রাগ-অনুরাগ। আবার অনেক সময়ে আমরা অনেক কিছু আগে থেকেই কেন জানি বুঝতে পারি। অনুভব করতে পারি । এই জাতীয় বিষয়গুলো সঠিক জ্ঞানের বা বিশ্বাসের অভাবে আমরা যুক্তিযুক্তভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি না। আমাদের অন্তর্দৃষ্টি এবং মস্তিষ্কের মিথস্ক্রিয়ায় তৈরী তরঙ্গ অগ্রিম ভাবে কোন ভবিতব্য উপলব্ধি করতে আমাদেরকে সাহায্য করে ।

এজন্যই বিভিন্ন কারনে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রার্থনা আমাদের ভিতর থেকে আসে। প্রার্থনার বাক্য সমূহ কেমন হবে তার পরিস্কার ধারনা পাওয়া যায় বিভিন্ন আসমানি বা জমিনী ধর্মীয় গ্রন্থে । একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে নিবেদিত প্রার্থনা মস্তিস্কে একটি বৈদ্যুতিক -তরঙ্গ হিসাবে প্রকাশ পায়। দোয়া আমাদের প্রত্যাশা অর্জনের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। প্রার্থনা একটি অনুশীলনের বিষয়। সুতরাং যদি আমরা আমাদের ন্যায়সঙ্গত চাওয়া পাওয়া ঠিক বুঝতে পারি, প্রার্থনা মন থেকেই আসবে এবং মস্তিষ্ক ঠিক সেভাবেই আমাদেরকে পথনির্দেশনা দিবে। কিছু জ্ঞানী ব্যক্তিদের প্রার্থনা বিষয়ক কিছু উক্তি এখানে উদ্ধৃত না করে পারছিনা। মার্টিন লোথার কিং বলেছেন, ‘It is a tremendously hard thing to pray aright, yea it verily the science of all sciences’ । স্যার থোমাস বলেছেন, ‘You know the value of prayer. It is precious beyond all price. Never neglect it.” । একজন ব্যক্তির মস্তিষ্কের ক্ষমতা যত বেশি শক্তিশালী, তার প্রার্থনা মস্তিষ্কে তত বেশি অনুরনিত হয়। পার্থিব সমস্ত চিন্তাভাবনার উর্ধে উঠে আমরা প্রার্থনা করতে পারলে তা বেশি মাত্রায় উর্ধস্তরে সম্প্রচারিত হয়। মস্তিষ্ক প্রেরিত এই ফ্রিকোয়েন্সিগুলি গৃহীত হয় এবং আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করে।

দর্শনশাস্ত্র মতে মানুষের মন হচ্ছে তাঁর বুদ্ধি এবং বিবেকবোধের এক সমষ্টিগত রূপ। আবেগ, অনুভূতি, চিন্তা , ইচ্ছা, এবং কল্পনার মাধ্যমে আমাদের মন আলোড়িত হয়। মনের প্রবৃত্তির কোন কিছুই শরীর থেকে আলাদা নয়। মস্তিষ্কের নির্দেশনায় পরিচালিত পুষ্টি, শ্বসন, ক্ষরণ, রেচন, জনন প্রভৃতি শারীরবৃত্তীয় কার্যাবলীর মাধ্যমে মন গড়ে উঠে। সহজ কথায়, মন হলো এমন কিছু যা নিজের অবস্থা এবং ক্রিয়াগুলি সম্পর্কে সচেতন।

অনেকের মতে মন বলতে — চিন্তা, অনুভূতি ও ইচ্ছা এই মানসিক কাজগুলি থেকে স্বতন্ত্র — দেহাতিরিক্ত একটা স্থান। অপরিবর্তিত আধ্যাত্ম-সত্তা বা আত্মাকে বুঝায়। কেউ বা বলছে আত্ম শব্দের অর্থ আমার। আত্মা শব্দের অর্থ আমি । গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ব্যক্তি কোন শব্দ শুনতে পায়না। তাকে স্পর্শ করলে সে বুঝতে পারে না । চোখের পাতা তুলে ধরলেও সে কিছু দেখতে পায় না । আত্না একটা চেতনা যা অচেতন অবস্থায়ও সজাগ থাকে। যা মানুষ শুধু কল্পনা করতে পারে। কিন্তু আত্মাকে সে স্পর্শ করতে পারেনা।

মানুষ মন দিয়েই অনুপস্থিত কাউকে উপলব্ধি করতে পারে। মনোজগতে সৃষ্ট চিন্তা-চেতনা-ধ্যান-ধারণা, সুখ-দুঃখ-অনুভতি শরীরের আচরণের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। মানুষের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ঘুম, যৌনতা, রেচন প্রভৃতি জৈবিক চাহিদা রয়েছে। এ চাহিদাগুলো যখন পূরণ হয়ে যায়, মানুষ তখন নানারকম মানবিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যাবলী সম্পাদনে উদ্যোগী হয়। সাংস্কৃতিক চর্চা, বৈজ্ঞানিক চর্চা, দার্শনিক চর্চা, সাহিত্য চর্চা, গল্প , আরাম, আয়েশ করে। এ সব কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষের মাঝে প্রেম-প্রীতি, স্নেহ, ভালোবাসা, মমতা ও প্রশান্তি, প্রভৃতি ধনাত্মক বিষয়গুলো বিকশিত হয় । এবং ক্রোধ, হিংসা প্রভৃতি ঋণাত্মক বিষয়গুলো থেকে সে নিজেকে মুক্ত করতে পারে । আর ধর্ম চর্চা এবং ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার মাধ্যমে মানুষ প্রশংসনীয় অতি মানবিক আচরনে অভ্যস্ত হয়।

কম্পিউটার বিজ্ঞানী অ্যালান টুরিং এর মতে অমানবিক মানসিকতার সম্ভাবনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ক্ষেত্রে উদ্ভাবিত হয়। সাইবারনেটিক এই বুদ্ধিমত্তা তথ্য তত্ত্বের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়ে কাজ করে। তাঁর মতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সমৃদ্ধ কোনো যন্ত্রকে যদি অ্যালগরিদমের আওতাধীন করা হয়, তাহলে সেটার পক্ষে সকল গাণিতিক সমস্যার নির্ভুল সমাধান সম্ভব।

কিন্তু মানুষ অনাগ্রহ-অবহেলার জন্য তথ্য তত্ত্বের প্রক্রিয়াগুলি সমন্বয় করতে পারেনা। গণিতবিদ রেনে ডেকার্টস বিশ্বাস করতেন “Inputs are passed on by the sensory organs to the epiphysis in the brain and from there to the immaterial spirit.” বহির্জগতের প্রভাবে সৃষ্ট অনুভূতি ইনপুট হিসেবে দেহের বিভিন্ন অংশে থাকা স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছে। এবং তা থেকে সৃষ্ট সংকেত আধ্যাত্ম-সত্তা বা আত্মার কাছে পৌঁছে।

স্বাস্থ্যগত সকল টেস্ট রিপোর্ট ভালো আছে। অথচ শারীরিক কষ্ট হচ্ছে। দেহের নানা স্থানে ব্যথা-বেদনা হচ্ছে । বাস্তবে কোন কিছু একটার অস্তিত্ব নাই। কিন্তু অনেকে তা দেখছেন। আশেপাশে কেউ নেই । অথচ সে অনেক কিছু শুনছেন। অদ্ভুত অদ্ভুতুড়ে অনুভব হচ্ছে। মন খারাপ। মনে অনেক দুঃখ-কষ্ট-যাতনা। এসব শরীরের উপর রীতিমতো প্রভাব ফেলছে । অথচ অতীব দুঃখের বিষয় হচ্ছে, যে মনটা এতো কিছু করছে তাকেই তো দেখছিনা।

অনুচ্ছেদ — ১০ এ বলেছিলাম, অনেকের মতে মন বলতে — চিন্তা, অনুভূতি ও ইচ্ছা এই মানসিক কাজগুলি থেকে স্বতন্ত্র — দেহাতিরিক্ত একটা স্থান। অপরিবর্তিত আধ্যাত্ম-সত্তা বা আত্মাকে বুঝায়। কেউবা বলছে — যেহেতু আত্ম শব্দের অর্থ আমার, সেহেতু আত্মা শব্দের অর্থ আমি ।

মানুষ মন দিয়েই অনুপস্থিত কাউকে উপলব্ধি করতে পারে। মনোজগতে সৃষ্ট চিন্তা-চেতনা-ধ্যান-ধারণা, সুখ-দুঃখ-অনুভতি শরীরের আচরণের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। মানুষের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ঘুম, যৌনতা, রেচন প্রভৃতি জৈবিক চাহিদা রয়েছে। এ চাহিদাগুলো যখন পূরণ হয়ে যায়, মানুষ তখন নানারকম মানবিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যাবলী সম্পাদনে উদ্যোগী হয়। সাংস্কৃতিক চর্চা, বৈজ্ঞানিক চর্চা, দার্শনিক চর্চা, সাহিত্য চর্চা, গল্প , আরাম, আয়েশ করে।

এ সব কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে প্রেম-প্রীতি, স্নেহ, ভালোবাসা, মমতা, প্রশান্তি, প্রভৃতি ধনাত্মক বিষয়গুলো বিকশিত হয় । এবং ক্রোধ, হিংসা, লোভ, লালসা প্রভৃতি ঋণাত্মক বিষয়গুলো থেকে সে নিজেকে মুক্ত করতে পারে । আর ধর্ম চর্চা এবং ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার মাধ্যমে মানুষ প্রশংসনীয় অতি মানবিক আচরনে অভ্যস্ত হয়।

কম্পিউটার বিজ্ঞানী অ্যালান টুরিং এর মতে অমানবিক মানসিকতার সম্ভাবনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ক্ষেত্রে উদ্ভাবিত হয়। সাইবারনেটিক এই বুদ্ধিমত্তা তথ্য তত্ত্বের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়ে কাজ করে। তাঁর মতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সমৃদ্ধ কোনো যন্ত্রকে যদি অ্যালগরিদমের আওতাধীন করা হয়, তাহলে সেটার পক্ষে সকল গাণিতিক সমস্যার নির্ভুল সমাধান সম্ভব।

অতি সহজ ভাষায় অ্যালগরিদমকে বলতে পারি গাণিতিক বা অন্যান্য সমস্যা-সমাধানের জন্য নির্দেশাবলী বা নিয়মাবলী যা অনুসরন করলে গণনা বা অন্য যে কোন সমস্যার সমাধান অতি সহজে খুজেঁ পাওয়া যায়।

কিন্তু মানুষ তার অনাগ্রহ-অবহেলা-অলসতার জন্য অ্যালগরিদমের তথ্য — তত্ত্বের প্রক্রিয়াগুলি সমন্বয় করতে পারেনা। বিশিষ্ট গণিতবিদ রেনে ডেকার্টস বিশ্বাস করতেন “Inputs are passed on by the sensory organs to the epiphysis in the brain and from there to the immaterial spirit.”। অনুবাদ করলে এরকম কিছু একটা হয় — বহির্জগতের প্রভাবে সৃষ্ট অনুভূতি ইনপুট হিসেবে দেহের বিভিন্ন অংশে থাকা স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছে। এবং তা থেকে সৃষ্ট সংকেত আধ্যাত্ম-সত্তা বা আত্মার কাছে পৌঁছে।

ঠিক আছে মানছি — আত্ম শব্দের অর্থ আমার। “আমার আমার কে কয় কারে ভাবতে গেলো চিরকাল। আমারে কেউ চিনতে গেলে সোজা রাস্তা হয় যে বাঁকা।” — কি চমৎকার ভাবনা। আমার বাড়ি। আমার গাড়ি। আমার জমি। এখান থেকে যেটুকু জমিন দেখছেন সব আমার। আসলে সব কিছুই কি আমার — মোটেই না। সবকিছুর মালিক হচ্ছেন এক এবং অদ্বিতীয় মহান রাব্বুল আলামিন।

অতি সাধারণ একটা উদাহরণ দিচ্ছি। প্রথম মোঘল সম্রাট ছিলেন সম্রাট বাবর। তিনি ১ এপ্রিল ১৫২৬ সনে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা করেন। তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশের ৪০ লক্ষ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে। ব্রিটিশ সরকার পরিচালিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮৫৭ সালে শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহকে সিংহাসনচ্যুত করে এবং রেঙ্গুনে নির্বাসিত করে। সেই সাথে বিলুপ্ত হয় মুঘল সাম্রাজ্যের। নির্বাসনে থাকা অবস্থায় তিনি অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করেন। এই হচ্ছে আমার সাম্রাজের অবস্থা। নিশ্চয়ই কোথায়ও কোন নিয়মাবলী-নির্দেশাবলী অনুসরনে বা গণনায় কোন সমস্যা ছিল।

কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন ইয়া আল্লাহ! তুমিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান কর আর যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর আর যাকে ইচ্ছা অপমান কর। তোমারই হাতে রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই তুমি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল।’

মনে হচ্ছে — আমার বলে কিছু নেই। তাই আত্ন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অর্থাৎ আমার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ রকম একটা গীবত প্রায়ই শুনি — তার একদম আত্না নেই। সে কাউকে কোন প্রকার আর্থিক-মানসিক সাহায্য-সহযোগিতা করেনা। এ দিয়ে বক্তা উক্ত ব্যক্তির মনের ব্যাপারে কটূ কথা বলতে চেয়েছেন। ধরে নেই — আমার আত্না নেই। তাহলে আত্না অর্থ আমি হলে মানে দাঁড়াচ্ছে আমার আমি নেই। একবার কোন একটা সিনেমায় বা কোথাও কোন একটা জায়গায় দেখেছিলামি — একজন শিক্ষিত লোক মাতাল হয়ে বলছিল একই কথা বার বার। আর কথাটি ছিল — আমি কিন্তু নেই। — আমি কিন্তু নেই। কথাটির সাথে মিলিয়ে লোকটি অঙ্গভঙ্গি করছিল। আমার হাসি উঠছিল কথাটি শুনে।

এখন আলোচনার জন্য তার উক্তিটির একটু বিশ্লেষন করার চেষ্ঠা করি। অনুচ্ছেদ — ১০ এর কথাটি পুনরায় উল্লেখ করছি চোখের সামনে আনার জন্য। আত্না একটা চেতনা যা অচেতন অবস্থায়ও সজাগ থাকে। যা মানুষ শুধু কল্পনা করতে পারে। কিন্তু আত্মাকে সে স্পর্শ করতে পারে না। তাহলে ভদ্রলোকটির কথাটির মানে দাঁড়াচ্ছে — আমি কিন্তু নেই — আত্না কিন্তু নেই। যদি সে বুঝেই বলে সে বলছিল — চেতনা কিন্তু নেই। অর্থাৎ আমার কোন চেতনা নেই। গল্প গুজবে শুনেছি মানুষ নাকি মদ খেয়ে সত্য কথা বলে। ধরে নেই, লোকটি তখন কোন ভান ধরে ছিলনা। তাহলে আসলে মদ খেয়ে সে সত্যিই বলছিল। তার চেতনা সে হারিয়ে ফেলেছে। এবং সে এটা তার ভুল কাজের জন্য হারিয়ে ফেলেছে। আর এরকম একটা ব্যাখা দাঁড় করিয়ে আমি নিজেই মজা পাচ্ছি এই ভেবে যে — আমরা ভুল কাজ করে, অপরাধ করে, গুনাহ করে, নির্দেশাবলী-নিয়মাবলী অমান্য করে আমাদের চেতনা হারিয়ে ফেলছি। আত্নার সঙ্গে আমাদের সংযোগ হারিয়ে ফেলছি। মনে হচ্ছে আত্নার সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি। ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এমন একটা উদাহরণের মাধ্যমে এই ধরনের একটা বিশ্লেষণ বা এনালাইটিক্যাল এবিলিটি দেখানোর জন্য। আল্লাহ আপনি আমাকে ক্ষমাকরুন। আমিন। এই আবোল-তাবোল ভাবনাগুলোকে দয়া করে কেউ আবার ধর্মীয় বিধিবিধানের সাথে তালগোল পাকিয়ে ফেলবেন না। আর এতো বিশ্লেষণে যাচ্ছিনা, ইনশা আল্লাহ।

আত্নার সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য প্রয়োজন আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের স্মরণ। মনে মনে আল্লাহ আল্লাহ উচ্চারন। অনেক অনেক আগে কোথাও পড়েছিলাম বা শুনেছিলাম। তাই হয়তো হুবহু উদ্ধৃত করতে পারছিনা। তাও করছি শুধুমাত্র বুঝানোর জন্য যে আল্লাহর স্মরন কতোটা কঠিন এবং জরুরী। এক ব্যক্তি একদা এসে নবী করিম (সা.) এর কাছে আরজ করলেন, আমি একজন শ্রমজীবী মানুষ। আমি ঠিক সময়মত নামায-রোজা আদায় করতে পারিনা। আমাকে অন্য কোন পথ, পন্থা ,পদ্ধতি বাতলিয়ে দিন। যাতে আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা পেতে পারি। তখন নবীজী বললেন , তাহলে তুমি সর্বদা তোমার জিহ্বাকে আল্লাহর জিকিরে (স্মরণে) সিক্ত রাখো। লোকটির কাছে সমাধানটি অত্যন্ত সহজ মনে হলো। সে সঙ্গে সঙ্গে তাই করতে শুরু করলো। আল্লাহর নাম স্মরণ করতে লাগল। অতপর প্রস্থান করলেন। নবীজী তখন উপস্থিত সাহাবীদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, লোকটি ক্রমশঃ জান্নাতের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সবাই বললেন, কেন ইয়া রাসূল আল্লাহ (সা.)। উত্তরটা এই রকম ছিল যে — ইহা অত্যন্ত কঠিন কাজ। আসলেই চব্বিশ ঘন্টার কাজ। যেমন আমরা যারা আল্লাহর রহমতে বেঁচে আছি অবিরত আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। প্রতি মিনিটে প্রায় ১৮ বার। প্রতি ঘণ্টায় ১ হাজার ৮০ বার। এবং প্রতিদিনে ২৫ হাজার ৯২০ বার আমরা শ্বাস নিই। একবারের জন্যও এসব আমাদের খেয়াল করতে হয় না।

সত্যিই, আমরা খেয়াল করিনা। কিন্তু একবার শ্বাস নিতে ঝামেলা হলে বা এক নিঃশ্বাসের হেরফের হলেই আমরা সেটা টের পাই। সংবাদ মাধ্যমে নিশ্চয়ই আমরা ইতমধ্যে সবাই দেখেছি। দেখছি। সকলের সমবেদনা হচ্ছে। কি কষ্টই না করছে মৃত্যু পথযাত্রী করোনা রোগী । ভ্যান্টিলেটর দিয়ে একটু আরাম দেয়ার কতো শত চেষ্ঠা করছেন আমাদের চিকিৎসকরা। গাড়ি-নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো দিন-রাত ভ্যান্টিলেটর বানানোর তাগাদা অনুভব করছে। প্রকৌশলীরাও বসে নেই। নিত্য নতুন ডিজাইন করছেন একটা অধিকতর কার্যকরী ভ্যান্টিলেটর বানানোর জন্য।

মহান সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই তাঁর সৃষ্টিজগতের সমস্ত বিষয়ে অবগত আছেন। আমাদের মনের যাবতীয় ভাবনা সম্পর্কে অবগত আছেন। তিনি অন্তর্যামী । যিনি অন্তরে অবস্থান করেন। মনের সকল কথা জানেন। তিনি গহীন ভিতরে অবস্থান করে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। তাই আমরা সদা সত্য কথা বলার অভ্যাসটা আজ থেকে চর্চা শুরু করি। কারন এটা এমন একটা সৎ গুন যাতে অভ্যস্ত হলে প্রায় সমস্ত পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা যাবে। এগুলিকে ভিত্তি গুন বলে । এই একটা গুনই অন্য সকল প্রকার সৎ গুনাবলীকে চাঙ্গা করে তুলতে সক্ষম। এ বিষয়ে সোনালী যুগের অনেক ধর্মীয় উপদেশ মূলক গল্প আছে । হয়তো আমরা অনেকে জানি। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে যে মানতে পারছিনা। আর ক্রমশঃ আমাদের দুর্ভাগ্যকে আমরা ডেকে আনছি। অতি সামান্য একটা উদাহরন দিতে চাচ্ছি। ধরে নিই, ইতিমধ্যে আমরা সবাই এই সৎ সত্য বলার গুনটা রপ্ত করে ফেলেছি । আলহামদুলিল্লাহ। মাফ চেয়ে নিচ্ছি করজোড়ে। এবার দেখিনা এবছরে — ধর্মীয় অনুশাসনের যাকাত আর রাষ্ট্রীয় নির্দেশনার ট্যাক্সের হিসাবটা আমার বা আমাদের কেমন দাঁড়ায় ।

যেহেতু তিনি আল্লাহ অন্তর্যামী, আমাদের যে কোন প্রয়োজনে তাঁর কাছেই সাহায্য এবং করুণা ভিক্ষা করিনা অমরা। আর বারে বারে প্রার্থনার পুনরাবৃত্তি করা উচিৎ। প্রার্থনা করার সময় অবিচল থাকা উচিত। পুনরাবৃত্তি না করলে নিজের কাছেই মনে হবে আমাদের এটার খুব একটা দরকার নেই। মনে হবে যেন এটি একটি সাধারণ চাওয়া। অনুনয় বিনয়ের মাধ্যমে চাইলে তা সফলকাম হবেই। সেই কারণে পুনরাবৃত্তি করা এবং অধ্যবসায় প্রার্থনার মূল উপকরন। এতে নিজের ভিতর প্রভাব সৃষ্টি হয়। নিজের ভিতর সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব অনুভব হয়।

প্রার্থনা পুনরাবৃত্তি মাধ্যমে জোরদার হয়। যেমন রসায়ন এবং কেমিপ্রকৌশলের জ্ঞান থেকে বলছি — যে কোন বিক্রিয়া শুরু হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট পরিমানের একটা এক্টিভেশন এনার্জির প্রয়োজন হয়। তা অতিক্রম করে গেলে বিক্রিয়া সচল হয়। আর চেইন ক্যামিক্যাল রিয়াকসন তো চলতেই থাকে। আর বন্ধ হয়না। তেমনি মস্তিস্কের মধ্যে চলতে দিইনা তাঁর স্মরণ। আর মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে সংযুক্ত হইনা নিজের মনের সাথে। আর মন না মতি কথাটা একদমই ভুলে যাই।

সৃষ্টিগত ভাবে মানুষ চঞ্চল। আল-কুরআনুল কারীম থেকে উদ্ধৃত করছি — ‘যাঁরা দাঁড়িয়ে, বসে, ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা গবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষয়ে, (তারা বলে) পরওয়ারদেগার, এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। সকল পবিত্রতা তোমারই, আমাদিগকে তুমি দোযখের শাস্তি থেকে বাঁচাও। নিশ্চয় আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি শ্রেষ্ঠতম-সুন্দর আকৃতিতে।’

প্রাচীন আরবি, ফার্সি, উর্দু কবি সাহিত্যিকগণ তাঁদের রচনাবলীতে আবজাদী হিসাব ব্যবহার করতেন। উদাহরনস্বরুপ বলা যায়, আবজাদী হিসাব গণনা বা সংখ্যাতত্ত্ব আনুযায়ী — ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ এর সংখ্যা ৭৮৬ ধরা হয়। তাঁদের মধ্য হতে একজন কবির দুইটি ছত্র উদ্ধৃত করছি: ‘রাস্তি চুঁ আউয়্যালীনে আহ্মদি। দর সখুন চুঁ আখেরীনে আবজাদি।’ অর্থাৎ — সততার মধ্যে তিনি ছিলেন আহমদের প্রথম অক্ষর ‘আলিফের’ ন্যায় সোজা-সরল। (এবং ) সত্যবাদিতা-সততায় ও কথাবার্তায় তিনি ছিলেন আবজাদের শেষ অক্ষর ‘গাইন’ এর ন্যায়। ‘গাইন’কে আবজাদী সংখ্যাতত্ত্বের মতে হাজার বা সহস্র হিসেবে গণনা করা হয় । আরবিতে ‘হাজারুন’ অথবা ‘হুজারুন’ — বুলবুলি বা কোকিলকে বলা হয়। অর্থাৎ বুলবুলি বা কোকিল কণ্ঠের ন্যায় আর্কষণীয় হৃদয়গ্রাহী। মানুষের শ্রেষ্ঠতম-সুন্দর আকৃতিতে উক্ত ছত্র দুটির সংমিশ্রন অতি প্রয়োজন।

এবারে আসছি পবিত্র ধর্মগ্রন্থ তিলাওয়াত করার বিষয়ে। সমস্ত রোগ থেকে আরোগ্যের উপায় বিভিন্ন ভার্সে রহস্যাবৃত আছে। বিশিষ্ট জনদের মতে — বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সে আয়াতসমূহ নির্দিষ্ট সংখ্যায় পুনরাবৃত্তি করলে, প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিতে যা নিরাময়যোগ্য নয় তা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এটা আশ্চর্যজনক যে, যতাযত আদব- মহববতের সহিত, ধীরস্থীর-যথার্থ-সহীহ-শুদ্ধভাবে, অর্থ বুঝে এবং তা অনুধাবন করে কুরআন তেলাওয়াত বা ধর্মগ্রন্থ পাঠ করার ফলে উচ্চারিত শব্দ — কান থেকে মস্তিষ্কে পৌঁছে উক্ত শব্দে নিহিত ফ্রিকোয়েন্সি বা তরঙ্গ শক্তির মাধ্যমে — রোগ নিরাময়ের নির্দেশ প্রদানে এক দুর্দান্ত ভূমিকা পালন করে। যার প্রভাব পুরো দেহে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।

মস্তিষ্ক আমাদের পুরো শরীর নিয়ন্ত্রণ করে। কুরআন তেলাওয়াতের ফলে মস্তিষ্ক শরীরের প্রত্যেকটি কোষে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে জোরদার করে। শরীরকে রোগের সাথে লড়াই করার জন্য নির্দেশ প্রদান করে । বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে, সুনির্দিষ্ট সুরগুলি পানির অণুর বৈদ্যুতিক চৌম্বকীয় ক্ষেত্রকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে । আমরা সকলে একথা জানি — মানবদেহ ৭০ শতাংশ পানি দিয়ে গঠিত। কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে আমরা যে শব্দগুলো তৈরি করি তা আমাদের দেহের কোষগুলোতে থাকা পানির অণুগুলির আকৃতি এবং কম্পনের পরিবর্তন ও পুনর্বিন্যাসকে নিয়মিত করে । যা কিনা মানুষের রোগ প্রতিরোধে, তথা অদৃশ্য শত্রু যেমন ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া মোকাবেলায় হার্ড ইম্যুনিটি তৈরী করে।

নিজের ক্ষমতার ব্যাপ্তি দেখে নিজেই বিস্মৃত হয়েছিল ফেরাউন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, সেনাবাহিনী, পারিষদবর্গ এবং প্রাসাদের জৌলুস ফেরাউনকে উদ্ধত করেছিল। নিজেকে খোদা দাবি করেছিল ফেরাউন। কিন্তু ফেরাউন সাগরে ডুবে মারা যায়। আল্লাহর আজাব দেখে ফেরাউন তাওবা করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তার তাওবা গৃহীত হয়নি। পৃথিবীবাসীর কাছে তাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে রেখে দিয়েছেন মহান সৃষ্টিকর্তা।

মাদইয়ানবাসী পার্থিব লোভ-লালসায় মত্ত হয়ে পারস্পরিক লেনদেনের সময় ওজনে কম দিয়ে মানুষের হক আত্মসাৎ করত। দুর্নীতি, রাহাজানি, ছিনতাই, ধর্ষণ ও মজুদদারির মতো জঘন্য অন্যায় কাজ তাদের সমাজে বিষবাষ্পের মতো ছড়িয়ে পড়ে। অন্যের সম্পদ লুটপাট করত তারা। এসব পাপে তারা এমনভাবে লিপ্ত ছিল যে, তারা কখনো মনে করত না যে, এসব কাজ অত্যন্ত গর্হিত। বরং তারা এসবের জন্য গর্ববোধ করত। অন্যায় পথে জনগণের সম্পদ ভক্ষণ করত। অর্থনৈতিক অসততার জন্য বিধ্বস্ত হয়েছিল মাদিয়ান শহর এবং তার অধিবাসীরা।

আদ জাতির লোকেরা ছিল উন্নত। নির্মাণশিল্পে তারা ছিল জগৎসেরা। তারা সুরম্য অট্টালিকা ও বাগান তৈরি করত। তাদের তৈরি ‘ইরাম’ এর মতো অনিন্দ্য সুন্দর শহর পৃথিবীর আর কোথাও ছিল না। তারা অঙ্কন শিল্পেও ছিল দক্ষ। জ্ঞান-বিজ্ঞানে তারা যেমন অগ্রসর ছিল, তেমনি সংস্কৃতিতেও অনন্য। তারা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করত।

কিন্তু কালক্রমে তারা আল্লাহকে ভুলে যেতে শুরু করে। তারা মনে করত, তাদের সব অর্জন স্বীয় যোগ্যতায়। আদ জাতির শক্তি ও ক্ষমতার বাহাদুরি তাদেরকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে ফেলে। আদ জাতির অমার্জনীয় হঠকারিতার ফলে প্রাথমিক আজাব হিসেবে উপর্যুপরি তিন বছর বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকে। তাদের শস্যক্ষেত শুষ্ক বালুকাময় মরুভূমিতে পরিণত হয়। বাগবাগিচা জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যায়।

অতঃপর সাত রাত ও আট দিন ধরে অনবরত ঝড়-তুফান বইতে থাকে। মেঘের বিকট গর্জন ও বজ্রপাতে বাড়িঘর ধসে যায়। প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে গাছপালা উপড়ে যায়। মানুষ ও জীবজন্তু শূন্যে উত্থিত হয়ে সজোরে জমিনে পতিত হয়। নিমিষেই বিনাশ হয় আদ জাতির অট্টালিকা।

বিকৃত পাপে অভ্যস্ত ছিল ইরাক ও ফিলিস্তিনের মধ্যবর্তী ট্রান্স জর্দানের অধিবাসীরা। ট্রান্স জর্দান প্রাকৃতিক প্রাচুর্য দিয়ে পরিপূর্ণ ছিলো। এমন প্রাচুর্যময় জীবনযাত্রা বেপরোয়া করে তোলে তাদের। শুধু তাই নয়, পৃথিবীতে তাদের মধ্যেই সর্বপ্রথম সমকামিতার প্রবণতা দেখা দেয়। পৃথিবীতে পরিচিত ও অপরিচিত এমন কোনো অপরাধ নেই, যা সে জাতির ভেতর ছিল না। এই জঘন্য অপকর্ম তারা প্রকাশ্যে করে আনন্দ লাভ করত। এক শক্তিশালী ভূমিকম্প পুরো নগরটি সম্পূর্ণ উল্টে দেয়। ঘুমন্ত মানুষের ওপর তাদের ঘরবাড়ি আছড়ে পড়ে।

পাথরঘরে মুখ থুবড়ে পড়ে সামুদ জাতি। সামুদ জাতি শিল্প ও সংস্কৃতিতে পৃথিবীতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। কিন্তু তাদের জীবনযাপনের মান যতটা উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌঁছেছিল, মানবতা ও নৈতিকতার মান ততই নিম্নগামী ছিল। ন্যায়-ইনসাফ বলে সে সমাজে কিছুই ছিলনা। অন্যায় ও অবিচারে সমাজ জর্জরিত হতে থাকে। সমাজে চরিত্রহীন লোকের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। গগনবিদারী আওয়াজ সামুদ জাতির কর্ণকুহরে আঘাত হানে। সেই আওয়াজে তারা নিজ নিজ গৃহে উপুড় হয়ে পড়ে থাকে। একসময় যে জাতি পাহাড়ে ঘর নির্মাণ করত, পৃথিবীতে যাদের চেয়ে শক্তিশালী কোনো জাতি ছিল না, আসমানি আজাবে তারা মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।

এক ভয়ংকর প্লাবন ও জলোচ্ছ্বাস রাসিব জাতির সীমালঙ্ঘনকারী অবাধ্য লোকদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এমন প্লাবন সেই জাতিকে গ্রাস করেছিল, যেই প্লাবন হাজার বছর ধরে পৃথিবীতে ইতিহাস হয়ে আছে। এইসব জনপদের ধ্বংসাবশেষ এখনো বিদ্যমান।

পবিত্র কোরআনে একাধিক জাতির উপর নিপতিত এধরনের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এসব ঘটনা বর্ণনার উদ্দেশ্যও আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘নবীদের সংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলো আমি এ জন্য বর্ণনা করছি, যেন তার মাধ্যমে আমি আপনার হৃদয়কে দৃঢ় করতে পারি। এতে আপনার কাছে সত্য স্পষ্ট হয়েছে। আর মুমিনদের জন্য তাতে রয়েছে উপদেশ ও আমার স্মরণ।’

তেমনি অতীতে আল্লাহতা’লা কোনো কোনো গোত্রকে মহামারির মাধ্যমেও শাস্তি দিয়েছেন। তাছাড়া সেসব সমাজে এমন সব ব্যাধির উদ্ভব হয়েছিল, যা তাদের আগের মানুষদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। দাউদ (আ.)-এর যুগে এমন ঘটনা ঘটেছিল। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তুমি কি তাদের দেখনি যারা মৃত্যুভয়ে হাজারে হাজারে স্বীয় আবাসভূমি ত্যাগ করেছিল।’

আল্লাহর অবাধ্যতা, সীমালঙ্ঘন এবং অবাধ পাপাচার মহামারির অন্যতম প্রধান কারণ হলেও শুধু পাপীরাই তাতে আক্রান্ত হয় না। বরং সৎ ও নেককার মানুষও তাতে আক্রান্ত হয়। যেন মানুষ আল্লাহর দিকে ফিরে আসে। যেকোনো বিপদে মানুষ আল্লাহর মুখাপেক্ষী হোক এবং তাঁর কাছে ক্ষমা ও আশ্রয় প্রার্থনা করুক এটাই মহান প্রতিপালকের প্রত্যাশা।

পবিত্র কোরআনের একাধিক স্থানে বিপদে আল্লাহমুখী হওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। তাই বিশ্বাসীদের প্রধান কাজ হলো নিজের ভুল ত্রুটির জন্য আল্লাহর কাছে বিনীত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করা। বান্দা যদি আল্লাহর কাছে বিনীত হয়ে তাওবা করে এবং রাসুল (সা.)-এর নির্দেশ মোতাবেক ধৈর্যের পরীক্ষা দেয়, তবে আল্লাহ তাকে শহীদের মর্যাদা দান করবেন।

বেশির ভাগ মহামারিই সংক্রামক। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) মহামারির সংক্রমণ রোধে আক্রান্ত অঞ্চলে যাতায়াত নিষিদ্ধ করেছেন। এখানে উল্লেখ্য যে, সিরিয়ায় মহামারি দেখা দিলে হযরত ওমর (রা.) তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সফর স্থগিত করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, অসুস্থকে সুস্থের মধ্যে নেয়া যাবে না। ‘যদি তোমরা শুনতে পাও যে, কোনো জনপদে প্লেগ বা অনুরূপ মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে তবে তোমরা তথায় গমন করবে না। আর যদি তোমরা যে জনপদে অবস্থান করছ তথায় তার প্রাদুর্ভাব ঘটে তবে তোমরা সেখান থেকে বের হবে না। এভাবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রায় দেড় হাজার বৎসর পূর্বে সংক্রমন প্রতিরোধে বিচ্ছিন্নকরণ (quarantine) ব্যবস্থার নির্দেশনা প্রদান করেন। আধুনিক বিশ্বে কোয়ারেন্টিনের অনুশীলন শুরু হয় প্রথম ইতালিতে ১৪’শ শতকে।

বিশ্বাসীরা মনে করেন , সকল বিষয়ের ন্যায় রোগের ক্ষেত্রেও আল্লাহর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এজন্য সংক্রমনের ভয়ে অস্থির বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। পাশাপাশি যে সব রোগের বিস্তারে সংক্রমন একটি উপায় বলে নিশ্চিত জানা যায়, সে সকল রোগের বিস্তার রোধের ও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রনের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ছোঁয়াচে রোগ বা রোগের সংক্রমণ নিয়ে বেশি অস্থির হওয়ার ব্যাপারেও নিষেধ করা হয়েছে। ধৈর্য ধরতে হবে। অনেক সময়ে এমনটাও দেখা যাচ্ছে যে, রোগীর কাছে, বা চারপাশে থেকেও অনেক মানুষ সুস্থ রয়েছেন। আবার অনেক সতর্কতার পরেও মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন বিভিন্ন রোগে।

প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রকারের রোগজীবাণু আমাদের দেহে প্রবেশ করছে। বস্তুত শুধু রোগজীবাণুর সংক্রমনেই যদি রোগ হতো তাহলে আমরা সকলেই অসুস্থ হয়ে যেতাম। কারণ রোগজীবাণুর পাশাপাশি মানুষের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, রোগ জীবাণুর কর্মক্ষমতা ইত্যাদি অনেক কিছুর সমন্বয়ে মানুষের দেহে রোগের প্রকাশ ঘটে। পাশাপাশি সংক্রমনের বিষয়ে সতর্ক হতেও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নির্দেশ দিয়েছেন।

যেসব কারনে এসব জাতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল, মহামারীতে আক্রান্ত হয়েছিল, বর্তমান সমাজে অমরা নানাভাবে প্রতিনিয়ত এসব অন্যায় অত্যাচার চালাচ্ছি কিংবা এর স্বীকার হচ্ছি। তবে বিশ্বাস আছে পুরো সমাজ ব্যবস্থা এখনো গুনে ধরে যায়নি। সৎকর্মশীল, খোদাভীরু, সত্যবাদী মানুষও রয়েছেন এ সমাজে। অতীতেও ছিল যেমনটি বলেছিলাম নবী দাউদ (আ) এর সমসাময়িক ছিলেন পুণ্যবান, মুত্তাকি ওলি ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব লুকমান হাকিম যার নাম পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে ।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অসুস্থ, অসহায় এবং বিপদগ্রস্থ লোকের প্রার্থনা বেশি মন্জুর করেন। সর্বশেষ নবী আহমদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসেছিলেন এ জগতে যখন সমগ্র পৃথিবী আইয়ামে জাহেলিয়াতের মধ্যে নিমজ্জিত ছিল। মারামারি, হানাহানি, খুন-খারাবির উন্মোত্ততায় গোটা সমাজ ছিল টালমাটাল। পৃথিবীর সেই করুণ অবস্থা নিরসনের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার প্রিয় হাবীব মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সিরাজুম মুনিরা বা প্রদীপ্ত চেরাগরূপে প্রেরণ করলেন।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম, অমুসলিম, অনুগত, অবাধ্য, ছোট, বড়, নারী, পুরুষ, শিশু, ধনী, গরীব, বিভিন্ন রঙ, ভাষা, দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাভাবনা, বিশ্বাস ও স্থানের ভেদাভেদের উর্ধ্বে সকলের জন্যই রহমত। যারা তাঁর উপর ঈমান আনেনি, তাঁর কথা বিশ্বাস করেননি এমনকি তিনি তাদের জন্যও রহমত স্বরূপ প্রেরিত হয়েছেন। তাঁর রহমত শুধু মানবজাতির জন্য সীমাবদ্ধ নয়। বরং পশুপাখি ও জড়পদার্থের জন্যও তিনি ছিলেন রহমত। রাসূল (সা.) এর সারা জীবনের নানা ঘটনা ও অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে তা স্পষ্ট হয়।

মুশরিকদের উপর বদ দু‘আ ও অভিশাপ না করাও ছিল তাঁর করুণারই একটি বিশেষ অংশ। তাঁকে তাদের উপর বদ দু‘আ করতে আবেদন করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি অভিশাপকারীরূপে প্রেরিত হইনি। আমি কেবল করুণারূপে প্রেরিত হয়েছি।’ এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা মানবমুক্তির সংবিধান পবিত্র কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত করে প্রেরণ করেছি।’

আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় হাবীব মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গোটা জগৎ বাসীর জন্য অনুগ্রহ, দয়া বা করুনার প্রতীক করে প্রেরণ করেছেন। মনে প্রাণে তা সর্বান্তকরনে বিশ্বাস করি। অধিকাংশ আলেমের মতে সূরা তাওবার আয়াত — ১২৮ হলো সর্বশেষ নাযিল হওয়া আয়াত। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার বাণী।

বাংলা অর্থটি উদ্ধৃত করছি, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের নিজদের মধ্য থেকে তোমাদের নিকট একজন রাসূল এসেছেন। তা তাঁর জন্য কষ্টদায়ক যা তোমাদেরকে পীড়া দেয়। তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, পরম দয়ালু’। তাই আমাদের জন্য এটা মঙ্গলকর হবে যদি সর্বদাই দরূদ ও সালাম পেশ করি প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি। যাবতীয় স্তুতি ও প্রশংসা কেবল সেই মহান রব আল্লাহর জন্য যিনি আমাদের চলার পথের হিসেবে নাযিল করেছেন মহা পবিত্র গ্রন্থ আল-কুরআনুল কারীম।

পৃথিবীতে কারোরই গর্বভরে পদচারণা করা উচিত নয়। নিশ্চয়ই আল্লাহতা’লা কোনো দাম্ভিক অহঙ্কারী ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন যে, আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জাত বলেন, ‘ইজ্জত-সম্মান হচ্ছে আমারই পোশাক এবং গর্ব- অহঙ্কার হচ্ছে আমারই চাদর। তাই যে ব্যক্তি এ দুয়ের কোনোটি নিয়ে টানাটানি করবে, তাকে আমি কঠোর শাস্তি দেবো।’

একটু-আধটু সম্মান-সম্পদের কারণে তো বটেই, এমনকি আল্লাহর ইবাদত, ইলম, আমল নিয়েও আমরা অহঙ্কার করি। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাহ্যিক কিছু সুন্নতের ওপর আমল করেও আমরা কম-বেশি অহঙ্কারী হয়ে পড়ি। নিজেকে খুব আমলদার, পরহেজগার এবং সুন্নত পালনকারী ভেবে মনে মনে অন্যের ওপর শ্রেষ্ঠত্ববোধ করি। সেই আমিত্বের ভাব ও আচরণ নিয়ে সমাজে চলি।

অথচ এই দম্ভ ও অহঙ্কারের ভাবটুকুই প্রতিনিয়ত আমাদের যতটুকু ইলম, আমল বা সুন্নতের অন্তত বাহ্যিক পাবন্দি ছিল, সেগুলোকেও বেকার ও বরবাদ করে দেয় । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো মানুষ যখন নিজেকে নিয়েই কেবল ব্যস্ত থাকে, তখন এক পর্যায়ে তাকে দাম্ভিকের কাতারে লিপিবদ্ধ করে দেয়া হয়। তারপর দাম্ভিকের প্রাপ্ত সাজা-শাস্তি সেও পেয়ে থাকে।’

মূলত অহঙ্কার একটি রোগ। আর রোগ তো ধনী দরিদ্র যে কারো হতে পারে। এই অহঙ্কারকে বলা হয় ‘উম্মুল আমরায’ অর্থাৎ ‘রোগের মা’। কারণ, অহঙ্কার থেকেই নানাবিধ পাপ এবং অবাধ্যতার জন্ম হয়। তাই আমাদের বিগত মন্দকর্মের জন্য অনুতপ্ত হতে হবে। এবং ভবিষ্যতে তার পুনরাবৃত্তি না করার পাকাপোক্ত ইচ্ছা প্রকাশ করতে হবে। তাই হচ্ছে ‘তাওবাতুন নাসুহা।’

যেকোন প্রকারের অপরাধ এবং নিষিদ্ধ কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। বেশি আরামপ্রিয় হলে হবেনা। প্রয়োজন মাফিক হালাল রুটি-রুজির ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বক্ষণ আল্লাহর স্মরণে থাকতে হবে। ইবাদত-বন্দেগিতে আমাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। আল্লাহর প্রেমে মগ্ন হয়ে মরমি কবি হাসন রাজা আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমি না লইলাম আল্লাজির নাম না কইলাম তার কাম- বৃথা কাজে হাসন রাজায় দিন গুজাইলাম’। এই অনুতাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করি। অধিক পরিমানে সৎ কর্ম করি। সৎ চিন্তা করি।

বেশি বেশি দৈহিক সুখ-শান্তি নিয়ে আমরা ব্যস্ত না থাকি। লোকদের মতো না বলি, ‘ঘর বাড়ি ভালা নায় আমার’। আর হাসন রাজার মত ভাবি, ‘কি ঘর বানাইমু আমি, শূন্যের-ই মাঝার। ভালা করি ঘর বানাইয়া, কয় দিন থাকমু আর, আয়না দিয়া চাইয়া দেখি, পাকনা চুল আমার।’

হাসন রাজা বিশাল ভূসম্পত্তির মালিক ছিলেন। প্রথম যৌবনে তিনি ছিলেন ভোগবিলাসী ও শৌখিন। রমণীসম্ভোগে তিনি ছিলেন অক্লান্ত। তাঁর এক গানে নিজেই উল্লেখ করেছেন, ‘সর্বলোকে বলে হাসন রাজা লম্পটিয়া।’ গুনী মায়ের বুদ্ধিতে তিনি সর্বনাশা পথ থেকে ফিরেছিলেন। তাঁর মনের দুয়ার খুলে যেতে লাগল। তাঁর চরিত্রে এল এক সৌম্যভাব। বিলাসপ্রিয় জীবন তিনি ছেড়ে দিলেন। ভুলত্রুটিগুলো শোধরাতে শুরু করলেন। জমকালো পোশাক পরা ছেড়ে দিলেন।

শুধু বহির্জগৎ নয়, তাঁর অন্তর্জগতেও এল বিরাট পরিবর্তন। বিষয়-আশয়ের প্রতি তিনি নিরাসক্ত হয়ে উঠলেন। সাধারণ মানুষের খোঁজখবর নেওয়া হয়ে উঠল তাঁর প্রতিদিনের কাজ। কেবল মানবসেবা নয়, জীবসেবাতেও তিনি নিজেকে নিয়োজিত করলেন। তাঁর মনে এল একধরনের উদাসীনতা। তিনি আল্লাহর প্রেমে মগ্ন হলেন। টানলাম। নিজের ভেতরকার অতি সুন্দর রূপ দেখিলেন নিজের নয়নে। আর বাসনা ব্যক্ত করলেন এই ভাবে, ‘আমি যাইমুরে যাইমু, আল্লার সঙ্গে, হাসন রাজায় আল্লা বিনে কিছু নাহি মাঙ্গে।’ হাসন রাজার মতো বৈরাগী হতে বলছিনা। আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মোপলব্ধির ভেতর দিয়েই কীভাবে একজন সাধারণ মানুষ হাসন রাজা সম্পূর্ণ ভাবে নিজেকে বদলে ফেললেন তার জন্যই এই উদাহরনটা দিলাম।

অন্যায় চিন্তা ও কল্পনা না করি। স্বীয় সত্তা ও অস্তিত্ব বিলীন করি। আল্লাহর দিকে অগ্রসর হই। তাঁর নিকটবর্তী হই। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় তোমাদের ভেতর সেই ব্যক্তি সবচেয়ে সম্মানিত, যে সবচেয়ে বেশি খোদাভীরু।’

তরুণরা যে কোন মতবাদকেই প্রমাণ ছাড়া অতি সহজে গ্রহণ করতে চায় না। এটিই স্বাভাবিক। আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে এসে যেকোন বিষয়েই তারা বিজ্ঞান এবং ধর্মের বিধিবিধানের মাঝে আন্তঃযোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে। বিশ্বাসের জন্য প্রমান খুঁজে বেড়ায়। ইতিমধ্যে অনেক বিজ্ঞানী নিশ্চিত করেছেন যে, পবিত্র কোরআনে আকাশের নক্ষত্রমণ্ডল, উপজাতীয় কণার প্রকৃতি এবং মানব ভ্রূণের বিকাশের বিষয়ে — অধুনা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের অনুরুপ — বর্ণনা প্রায় ১৪’শ বছর আগেই উল্লেখ রয়েছে।

বিজ্ঞান দ্বারা আসমানী ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত অনেক তথ্য যুগ যুগ পরে যথাযথ প্রমাণিত হয়েছে। সম্ভবত আমরা অনেকেই এই বিষয়গুলি উল্লেখ করে আমাদের বিশ্বাসকে আরো দৃঢ় করতে চাই। ধর্মের প্রতি অবিশ্বাসীদের আস্থা আনতে চাই। সাথে সাথে নিজ নিজ ধর্মমতকে সর্বোচ্চ অবস্থানে রাখতে চাই। উন্মুক্ত হৃদয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। উন্মুক্ত দৃষ্টিতে দেখতে হবে। বিশ্ব-জগতের চারদিকে এবং নিজের মানবিক সত্তার মধ্যেই কেমন সব সুস্পষ্ট নিদর্শন আসমানী ধর্মগ্রন্থ সমূহের সত্যতার সাক্ষ্য দিয়ে চলছে।

বিজ্ঞান সার্বজনীন। তবে বিজ্ঞানের চর্চা সর্বদা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। এবং হচ্ছে। ভবিষ্যতেও হবে। কারোর বিজ্ঞান এবং ধর্ম চর্চার জন্য উক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক থাকার নেই। বরং বিজ্ঞানচর্চা নানাভাবে ধর্মীয় জ্ঞান দ্বারা উপকৃত হতে পারে। সরল বিশ্বাসীদের কাছে ধর্মীয় ঘটনা, নীতি, বিধিবিধান বৈধ করার জন্য বিজ্ঞানের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়না।

তবে পর্যবেক্ষণপূর্বক এটা বুঝা যায় যে — বিজ্ঞানের আধুনিক কালের গবেষণাগুলোর বিষয়ে আসমানী কিতাব সমূহে অনেক পূর্বেই ইঙ্গিত রয়েছে। এগুলো প্রজ্ঞায় পূর্ণ। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান এবং আবিষ্কারের সমস্ত উত্তর উপাদান এতে নিহিত আছে। আমরা আরও গণিত, আরও পদার্থবিজ্ঞান এবং আরও পরীক্ষার মধ্য দিয়ে তা বের করে নিজেরা উপকৃত হতে পারি।

চিরকালই ধর্মের বিষয়গুলো রহস্যময়। আছে নীরব। আমাদের রুদ্ধ ওষ্ঠাধর। বিশ্বাসে হয়তো মিলবে এসবের উত্তর। অকস্মাৎ সমাজকে বদলে দেয়ার বৃথা চেষ্টা না করে নিজেকেই আগে বদলে ফেলতে হবে। নিজের পথ নিজে তৈরি করতে হবে। নিজের জীবনকে নিজেই সাজাতে হবে।

যে ঝড়ো বাতাস বড় গাছ উপড়ে ফেলে, সেই বাতাসেই ঘাসেরা দোলে। তাই বড় হওয়ার দম্ভ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কি কী এড়িয়ে যেতে হবে বা বর্জন করতে হবে তা জানাই আজ বেশী জরুরী। যদি কেউ চাঁদের প্রত্যাশা করে, তবে সে রাত থেকে লুকিয়ে থাকলে হবেনা। যদি কেউ গোলাপের সুবাস পেতে চায়, পদ্ম ফুলটা আনতে চায়, তবে কাঁটা দেখে ভয়ে পালিয়ে গেলে হবেনা। তাই সমাজের জন্য ভালো কিছু একটা করতে হলে, আপন সৎ সত্তা হারিয়ে ফেললে যাবেনা।

যখন আমরা নিজের প্রত্যাশা, হিসাব আর চুক্তিকে প্রাধান্য না দিয়ে অন্যকে ভালোবাসতে শিখবো , তখনই আমরা প্রকৃত শান্তি অনুভব করতে পারবো। আমাদের যদি অতুল প্রতুল সম্পদ থাকে, সর্ব্বোচ্চ যতটা সম্ভব দান করতে হবে পরার্থে। আর যদি অপ্রতুল বা একদমই না থাকে তবে অর্থ-সম্পদের পরিবর্তে দান করতে হবে কায়িক শ্রম মানুষের কল্যাণে। আর তাতেও অক্ষম হলে করতে হবে সদাচার। দিতে হবে মানুষকে আমাদের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা। আর এখনই অর্থাৎ করোনার এই ক্রান্তিকালে এটা করার সবচেয়ে উত্তম সময়।

বেশিরভাগ কষ্ট ও মানসিক দুশ্চিন্তা মানুষের মুখের কথার কারনে সৃষ্টি হয়ে থাকে। কখনোই তাই অন্যের এধরনের কথায় বেশি গুরুত্ব দেওয়ার মানে নেই। নিরব থাকাটাই উত্তম। আমাদের সকলকে এসব নাবোধক চিন্তা থেকে মুক্তমনে বেরিয়ে আসতে হবে। চিন্তাচেতনায় হতে হবে ইতিবাচক। আশাবাদী। বুদ্ধিমান। বোধশক্তি সম্পন্ন। চটপটে ও দক্ষ।

জীবনের মন্ত্রটা কোনো এক মহাঞ্জানী-মহাজনের রচনা হতে অনুসৃত সুরের মতোই হওয়া উচিৎ — প্রবৃত্তি নিবৃত্তি ভবে, জান তিন ভাবে। বাক-বিতণ্ডা পরিহারে, জানার আগ্রহে, পর দোষ পরিহারে, নিজ দোষ ধ্যানে — বলে মনে করি। ‘আল্লাহ, আল্লাহ কলবেতে জপনারে ওরে মন। ঘুমে কেন রইলে অচেতন। দিবসতে ত্রিশ হাজার আল্লাহ আল্লাহ উচ্চারন। কবিরাজি শাস্ত্র বলে এইতো শিরার নিশান। শিরা নহে নিরাঞ্জনে চলে মোকামে মোকাম। মৃত্যু কালে চলে যাবে আপনার নিজ স্থান।’ — সাধকদের এধরনের কথাগুলো সত্যিই অনেক ভাবায়।

উপরে বর্ণিত…. জানার আগ্রহে, — বিষয়ে বলছি একটা ছোট গল্প। টাইটানিক ডুবছিল। প্রাণ ভয়ে সবাই চিৎকার করছিল। একজন বেশ নিরিবিলি আছেন। ভীষণ মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন পীথাগোরাসের উপপাদ্য। কয়েকজন এসে বলল, টাইটানিক ডুবছে। আর আপনি জ্যামিতি করছেন। তিনি বেশ শান্ত-স্বরে উত্তর দিলেন। বললেন, মরে যাবো — এটাতো নিশ্চিত। চিন্তা করে লাভ কী? তার চেয়ে ভালো যতক্ষণ আছি সে সময়টুকু কাজে লাগাই। উপপাদ্যটা বুঝে নেই। আর অমার এটা করতে বেশ ভালো লাগছে।

বিচিত্র মানুষ। আর আরো বিচিত্র মানুষের ভাবনা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ধর্মমতে — ‘অন্যায় চিন্তা ও কল্পনা হতে বিরত থাকতে হবে। সমস্ত পাপকাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। পাশাপাশি অলসতা থেকেও দূরে থাকতে হবে। সৎ কর্ম করতে হবে।’ আর সৎ কর্ম করাই ধর্ম।

ভাইরাস জনিত রোগে রোগীর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো থাকলে রোগের কোনো চিকিৎসা প্রয়োজন হয় না- এতোদিন এটাই শুনে আসছি। সেটা কোন বড় কথা নয়। এক্ষুনি বড় কথা হচ্ছে, করোনা খুবই ছোঁয়াচে একটা অনুজীব।

অনেকেরই প্রশ্ন, করোনা কী পরীক্ষাগারে সৃষ্ট? না প্রকৃতি সৃষ্ট দুর্যোগ? সে যাহাই হউক, সমগ্র মানবজাতি এখন গভীর সংকটে আছে। আমরা এক কঠিন ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। কে টিকে থাকবে কে পরাজিত হবে কেউ জানেনা। এটি সমগ্র বিশ্বকে শাসন করছে। তবে এটি আমাদেরকে পূর্বাপর ব্যাবস্থাপনা বিষয়ে সবক দিচ্ছে। নতুন করে নিজেদেরকে শোধরানোর সুযোগ দিচ্ছে।

স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার জন্য যার যার অবস্থান থেকে সবাই নিশ্চয়ই চেষ্ঠা চালিয়ে যাচ্ছি। তাতে কোন সন্দেহ নেই। কানাগলির শেষে আলো জ্বলছে। অনেক সংস্থা এবং একাডেমিক প্রতিষ্ঠান করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির জন্য চেষ্ঠা করছে। অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির একদল বিজ্ঞানী স্বপ্ন দেখেছেন যে, একদিন তারা শব্দ কম্পন,স্পন্দন, অনুনাদ বা প্রয়োজনে শ্রবণাতীত শব্দ-আল্ট্রাসাউন্ড ব্যবহার করে এসব চরম অবাধ্য ভ্রমনপ্রিয় ভাইরাসগুলোকে একইভাবে ধ্বংস করতে সক্ষম হবে যেভাবে অপেরার গায়করা তাদের ওয়াইন গ্লাসটি ছুড়ে ভেঙে ফেলে। এখনও অনেক দীর্ঘ পথ যেতে হবে। আমরা সকলেইে এ বিষয়ে আশা ও হতাশার মাঝে পেন্ডুলামের মতো করে দুলছি।

গবেষকরা নিশ্চয়ই যত দ্রুত সম্ভব করোনাভাইরাসের টিকা আবিস্কারের চেষ্ঠা করবেন। প্রথম আবিস্কারকের মেধাসম্পদের মালিকানা নিয়ে কোন দেশ ব্যবসা শুরু করবে। অর্থনীতিবিদরা দেশের অর্থনীতিকে আবার চাঙ্গা করে তোলার জন্য সচেষ্ঠ হবেন। আমরা আবার জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ব। এভাবেই চলবে টিকে থাকার সংগ্রাম। আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার চেষ্ঠা।

তার সাথে ইচ্ছে হলে, গভীর বিশ্বাস থাকলে আমরা রাখতে পারি ধর্মীয় বিধিবিধানের নিয়ন্ত্রন। নির্দেশিত পথে সাহায্য চাইতে পারি মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে। অনুনয় বিনয় করে। রোনাযারি করে। নিজের দোষ স্বীকার করে। নিশ্চয়ই তিনি আমাদের ক্ষমা করবেন যেমনটি তিনি বলেছেন পবিত্র ধর্মগ্রন্থে। সুতরাং, এই ঘোর বিপদে ঠিক এই মুহূর্তে প্রথমত আমাদের দরকার প্রার্থনা করা। দ্বিতীয়ত আমাদের দরকার প্রার্থনা করা। তৃতীয়ত আমাদের দরকার প্রার্থনা করা। ইংরেজি ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক এবং ইংল্যান্ডের জাতীয় কবি উইলিয়াম শেক্সপিয়ার আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘If I could pray to move, prayer would surely move me.’।

Image source: Internet

রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সওগাত নিয়ে ফিরে এসেছে পবিত্র মাহে রমজান। এই ক্রান্তিকালে আল্লাহর অসীম দয়া, ক্ষমা ও পাপমুক্তির এক সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হলো। রমজানের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যাবতীয় ভোগবিলাস, হিংসা-দ্বেষ, উচ্ছৃঙ্খলতা ও পারস্পরিক সংঘাত পরিহার করে ব্যক্তিগত ও সমাজজীবনে শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করি। আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করি। নৈতিক পরিশুদ্ধির মাধ্যমে নিজের চারিত্রিক গুণাবলি উন্নত করি। নিজেকে রক্ষা করি অশুভের ছায়া থেকে।

মানুষ তার পেট ও লজ্জাস্থানের অতিরিক্ত চাহিদা মেটানোর তাড়নায় সীমালঙ্গন করে। নফসের দাসত্ব জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় আমাদেরকে। তাই তাকে পুড়িয়ে ভস্ম করে ফেলি। খাঁটি সোনায় পরিণত করি। মোমবাতির মতো জ্বলে অন্যকে আলো দিই। দান-সাদকা করে বিপদগ্রস্ত অসহায় মানুষকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতে সচেষ্ট হই। আর নিজের অর্থসংকট-দুঃখ-ক্লেশে এবং সংগ্রাম-সংকটের সময় ধৈর্যধারণকারী।

হে মহান রাব্বুল আলামিন আমার এ রচনার ভুলত্রুটি আপনি ক্ষমা করুন। আপনাদের কাছেও ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। পুরো বিশ্ববাসীকে আপনি আল্লাহ এ ঘোর বিপদ থেকে রক্ষা করুন। আমাদেরকে সংকট সমাধানের উপায় বাতলিয়ে দিন। আমিন।

ফরিদ আহমদ — একজন গল্পকার, কলামিস্ট এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক।

--

--